কিশোর পিয়ার লিডার হিসেবে এনায়েতের পথচলা

শরণার্থী শিবিরে শিশু অধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে জীবন দক্ষতা শিখছে রোহিঙ্গা শিশুরা

তাসনীম কিবরিয়া
Anayet, a 15-year-old peer leader, in the Kutupalong refugee camp in Cox’s Bazar, Bangladesh.
UNICEF/UNI517336/Sujan
12 জুন 2024

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে পা রাখা মাত্র এনায়েতের বেঁচে থাকার নতুন এক সংগ্রাম শুরু হয়। মাত্র ৯ বছর বয়সেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এনায়েত, প্রতিদিন তার পরিবারের রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ ও পানি সংগ্রহের কঠিন দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে।

সময়ের সাথে সাথে দায়িত্ব বাড়তে থাকে এনায়েতের। অন্যান্য শরণার্থীর বাড়িতে বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার, চালের বস্তা তো কখনও বাঁশ বয়ে নিয়ে যেতে হতো তাকে। এই ভারী জিনিস গুলো প্রতিদিন বহনের ফলে তার শরীর ব্যাথা করতো। এতো কাজ করার পর পড়াশুনার করার সময় বা ধৈর্য কোনটাই থাকতো না এনায়েতের। 

“আমি প্রায়ই আমার বাবা-মাকে বলতাম, এগুলো খুবই ভারী; এগুলো তোলার পর আমার শরীর ব্যথা করে, আমার কষ্ট হয়। তখন আমার বাবা মা বলতো, আমাদের কাছে কোনো টাকা নাই। এজন্য তাদের আমার সহযোগিতা প্রয়োজন”, বলে এনায়েত।

শিশুশ্রম, শিশুদের প্রতি অবহেলা এবং শিশু নির্যাতন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এক নিয়মিত বাস্তবতা। কারণ অর্থনৈতিক কষ্টে জর্জরিত পরিবার গুলো প্রায়ই সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়।

UNICEF
Anayet's Fight Against Child Labour | World Refugee Day 2024 | UNICEF Bangladesh

শিক্ষার মাধ্যমে রূপান্তর

তিন বছর আগের কথা। একদিন এনায়েতকে রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে কাজ করতে দেখেন ইউনিসেফের কেসকর্মী সালাউদ্দিন। তখনই জীবনে পরিবর্তনের আশা দেখতে পেয়েছিলো এনায়েত।

একদিন এনায়েতের বাড়িতে যান সালাউদ্দিন। এনায়েতকে বহুমুখী কেন্দ্রে পাঠানোর বিষয়ে তার বাবার সাথে আলোচনা করেন তিনি। এছাড়াও ভবিষ্যতের জন্য কারিগরি দক্ষতা এবং জীবন দক্ষতা শেখার জন্য কেন্দ্রের কিশোর ক্লাবে যোগ দেয়ার বিষয়েও কথা বলেন তিনি। এরপর রাজি হন এনায়েতের বাবা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত বহুমুখী কেন্দ্রগুলোতে কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের জন্য কেস ব্যবস্থাপনায় সহায়তা, মনো-সামাজিক সহায়তা, জীবন-দক্ষতা সেশন ছাড়াও কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহনের সুযোগ দেয়া হয়।

রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে শক্তিশালী শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বহুমুখী কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে শিশুর বাবা-মা এবং শিশুর দেখাশুনা করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন (প্যারেন্টিং সেশন) করা হয় ও কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি পরিচালনা করা হয়।

এছাড়াও কেন্দ্রগুলো কিশোর-কিশোরীদের মৌলিক দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে থাকে। এই দক্ষতাগুলো যেকোন কঠিন সময়ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে, পরিবার ও কমিউনিটির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং কমিউনিটিতে সক্রিয় ভাবে অবদান রাখতে কিশোর-কিশোরীদের সহায়তা করে।

Anayet with his father and little sister at their home in the refugee camp.
UNICEF/UNI517318/Sujan
বাবা ও ছোট বোনের সাথে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিজ বাসায় এনায়েত

বহুমুখীকেন্দ্রের মাধ্যমে কিশোর ক্লাবে যুক্ত হওয়া এনায়েত জানায়, “জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমি শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর একদিন আমার বাবাকে বলেছিলামযে, ভারী জিনিসপত্র তোলা আর বয়ে বেড়ানো আমার শারীরিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই আমি এসব কাজ আর করতে পারবো না। আমার বাবা আমার কথা শুনেছিলেন এবং এরপর তিনি আমাকে আর কখনো ভারী জিনিসপত্র উত্তোলন বা অন্য কোন ভারী কাজ করতে বলেননি।”

এনায়েতের নিজের পরিবারও বাবা-মাদের জন্য আয়োজিত গ্রুপ সেশনে অংশনিতে শুরু করে; শুরু হয় পরিবর্তন। অল্পবয়সে কঠোর পরিশ্রমের কারণে ছেলের বিকাশে কী ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- এ সম্পর্কে একসময় জানতেন না এনায়েতের বাবা। এখন এনায়েতের পড়াশোনাকে তিনি সমর্থন করেন এবং তিন সন্তানকেই শরনার্থী শিবিরের শিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান।

পরিবর্তনের ঢেউ 

বহুমুখীকেন্দ্রের কিশোর ক্লাবে যোগ দেয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার বাড়ির কাছেই শিশুনির্যাতন ও শিশুর প্রতি অবহেলার এক ঘটনার স্বাক্ষী হয় এনায়েত। তখনতার বয়স মাত্র ১৩বছর।

"আমাদের প্রতিবেশীর ১০ বছরের মেয়েকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করা হয়।তার বাবা-মা তাকে পড়াশোনা করতে দিতো না। মাঝে মাঝে তাকে কম খাবার দেয়া হতো। এমনকি কখনও কখনও তাকে কিছুই খেতে দেয়া হতো না,” জানায় এনায়েত।

এনায়েত ওই পরিবারের কাছে যায় এবংসকল শিশুর সাথে সমানও ভালো আচরণের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের সাথে কথা বলে। পরবর্তীতে সহায়তার জন্য একজন কেসকর্মীকেও সেখানে নিয়ে যায় সে। কেসকর্মী নিয়মিত মেয়েটির বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে শুরু করেন। তিনি শিশু নির্যাতন ও শিশুর প্রতি অবহেলার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে মেয়েটির বাবা-মাকে অবহিত করেন। এরপর অবহেলার অবসান ঘটিয়ে মেয়েটিকে একটি শিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠায় তার বাবা-মা।

নিজ কমিউনিটির মধ্যে ইতিবাচক প্রভাবতৈরির স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্খা থেকে একজন কিশোর পিয়ার লিডার হয়ে ওঠে এনায়েত।

Anayet talks to two peers about life-skills and shares awareness messages on child abuse, child labour and more.
UNICEF/UNI517315/Sujan
দুজন সঙ্গীর (পিয়ার) সাথে জীবন-দক্ষতা নিয়ে কথা বলছেন এনায়েত। পাশাপাশি শিশু নির্যাতন, শিশুশ্রম এবং আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে সচেতনতামূলক তথ্য শেয়ার করছে তারা।

একজন পিয়ার লিডার হিসাবে, আমি আমার কমিউনিটির মধ্যে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, শিশুর প্রতি অবহেলাএবং শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো শনাক্ত করি এবং বন্ধ করতে সহায়তা করি," ব্যাখ্যা করেন এনায়েত।তার কথা বলার ভঙ্গিতেই তার দায়িত্ববোধের ব্যাপারটি ফুটে ওঠে।

এনায়েতকে ধন্যবাদ। নিজ অধ্যাবসায় ও সময় উৎসর্গ করে অন্যান্য কিশোর, কেসকর্মী, সহায়তাকারী এবং কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটির সাথে শিশুশ্রমের মতো ঘটনাগুলো বন্ধে কাজ করছে সে।তার হস্তক্ষেপে শিশুশ্রমের হাত থেকে রেহাই পাওয়াদের মধ্যে একজন কামাল হোসেন। প্রথমে পড়াশুনা করাতে রাজি ছিলেননা ১২ বছর বয়সী এই কিশোরের বাবা।

“আমি একদিন রাস্তায় কামালকে ভারী গ্যাস সিলিন্ডার বহন করতে দেখি। এরপর তার কাছে গিয়ে তার পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। কামালের ঘটনা অন্য শিশুদের মতোই”, জানান এনায়েত। এরপর এনায়েত কামালের বাবা-মার সাথে কথা বলে এবং ভারী কাজের চেয়ে ছেলের পড়াশুনাকে অগ্রাধিকার দিতে রাজি করায়।

Anayet talks to a child about the harmful effects of carrying heavy gas cylinders.
UNICEF/UNI517317/Sujan
ভারী গ্যাস সিলিন্ডার বহনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এক শিশুর সাথে কথা বলছে এনায়েত

যথাযথ সুযোগ পেলে প্রতিটি কিশোর-কিশোরী এগিয়ে যেতে পারে, বিকশিত হতে পারে – এনায়েত তা আবার প্রমাণ করল। অন্যান্য সঙ্গী (পিয়ার) এবং শিশু সুরক্ষা অংশীজন দের সাথে মিলে শিশুশ্রম ও শিশুর প্রতি অবহেলার মতো ২০টি ঘটনা প্রতিরোধে সহযোগিতা করেছে সে। একটি বাল্যবিবাহও বন্ধ করেছে সে। একটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাবের খবর শুনে বহুমুখী কেন্দ্রের কেসকর্মীদের সাথে তৎক্ষনাৎ বিষয়টি আলোচনা করে এনায়েত। তাদের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়েটি বন্ধ হয়।

শরণার্থী শিবিরে নানামুখি চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে এনায়েত। "আমি জীবনে ভালো কিছু করতে চাই। শিক্ষক হতে চাই আমি।এর মাধ্যমে আমার পুরো পরিবারের জীবনকে বদলে দিতে চাই," নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে এভাবেই বলে এনায়েত।