“পড়াশোনা করার সময় আমি অনেক কিছু ভুলে যাই”: সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে

বাংলাদেশের ৩ কোটি ৫০ লাখ পর্যন্ত শিশুর রক্তে বেশ উচ্চ মাত্রায় সীসা রয়েছে, যা তাদের স্বাস্থ্য ও বিকাশের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে

ইউনিসেফ
Bangladeshi child
UNICEF/UN0581379/Gregory
18 এপ্রিল 2022

এক রাতে, কাঠগোড়ায় অনিকের বাড়ির কাছে বাঁশের জঙ্গল থেকে ঘন কালো, তীব্র ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। এটি একটি অননুমোদিত কারখানা থেকে আসছিল, যেখানে কর্মীরা হাত দিয়ে সীসা-অ্যাসিডযুক্ত ব্যাটারি রিসাইকেল করার কাজ করছিল।

এই ধোঁয়া খুব দ্রুতই ঢাকা থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের গ্রামটির একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। সকালে আট বছরের অনিক ঘুম থেকে উঠে গাছের পাতায় কালির প্রলেপ দেখতো। সে ও তার ভাইবোনরা সেই জায়গার কাছেই খেলতো, যেখানে শ্রমিকরা উন্মুক্ত চুল্লিতে ব্যাটারি থেকে উদ্ধারকৃত সীসা গলানোর কাজ করতো।

এরপর একদিন তাদের পরিবারের গরুটি মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে গরুটি এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল এবং মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। অনিক ও তার পরিবার বুঝতে পারে যে ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা তাদের চারপাশের বাতাসকে দূষিত করছে এবং সীসার বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে।

সেই সময়কার পরিস্থিতি উল্লেখ করে অনিক বলে, “ওই জায়গা থেকে সবসময় কালো ধোঁয়া বের হতো, যা আমাদের অসুস্থ করে দিতো।”

“আমি ফুটবল খেলতে ভালোবাসি। আমি সেখানে খেলতাম। আমার মা ও দাদি আমাকে নিষেধ করার পর আমি সেখানে খেলা বন্ধ করে দেই,” সে জানায়।

অনিকের রক্ত ​​পরীক্ষা করা হলে তাতে স্বাভাবিক মাত্রার পাঁচগুণ বেশি সীসা পাওয়া যায়।

Anik, 8, with his younger brother - Bangladesh child
UNICEF/UN0620543/Gregory
ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আট বছর বয়সী অনিক তাদের ঢাকার কাঠগোড়ার বাড়িতে খেলছিল, যেখানে অননুমোদিত সীসা-অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিংয়ের কারণে শিশুদের জীবন-নাশকারী মাত্রার সীসার বিষক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে সীসার দূষণ মোকাবিলা

সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, বিশেষ করে এটা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। এটি শিশুদের মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে এবং তাদের পূর্ণ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

কাঠগোড়ার দূষণ স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষিপ্ত করে তুলে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিষাক্ত ধোঁয়া সহ্য করার পর গ্রামবাসী অবশেষে রিসাইকেল কারখানাটিকে সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করতে সফল হয়।

শিশুদের মধ্যে সীসার দূষণ ঠেকাতে ইউনিসেফের সহযোগী সংগঠন ‘পিওর আর্থ’ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মীদের সাথে নিয়ে কাঠগোড়ার কারখানার স্থানটি পরিষ্কার করেছে। তারা একসঙ্গে ব্যাটারির বর্জ্য নিরাপদে অপসারন করে, যা রিসাইকেল কারখানার কর্তৃপক্ষ যাওয়ার সময় ফেলে গিয়েছিল। তারা মাটিতে ছড়িয়ে থাকা অ্যাসিডে দূষণের শিকার বাঁশ গাছগুলোও অপসারণ করে এবং কয়েক ইঞ্চি বিষাক্ত মাটি সরিয়ে নেয়।

পিওর আর্থের ফিল্ড ইনভেস্টিগেটর মোহাম্মদ লুৎফুল কবির বলেন, “এখন এটি পরিষ্কার জমি। এখানে কোনো দূষণ নেই, কোনো সীসা দূষণ নেই।”

উচ্ছেদ অভিযান সম্পন্ন হওয়ার প্রায় ১৮ মাস পর শিশুদের রক্তে সীসার মাত্রা গড়ে কমে যায় প্রতি ডেসিলিটারে ৯.১ মাইক্রোগ্রাম - যা ছিল আগের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম।

 

সীসার বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ শিশু

ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ প্রকাশিত এই ধরনের প্রথম বৈশ্বিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, সারা বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি, যা এমন একটি মাত্রা যেটার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ প্রয়োজন। এই শিশুদের প্রায় অর্ধেক দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে।

শুধু বাংলাদেশে, আনুমানিকভাবে সাড়ে ৩ কোটি শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা খুব বেশি। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স ইভালুয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সীসার বিষক্রিয়ার কারণে মৃত্যুর হারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।

An informal lead battery recycling facility in Bangladesh
UNICEF/UN0581390/Gregory
একটি অননুমোদিত সীসাযুক্ত ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা

লোকালয়ের কাছাকাছি ব্যবহৃত লেড অ্যাসিড ব্যাটারির অবৈধ রিসাইক্লিং কারখানাগুলো প্রায়শই সীসার বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। মশলাতেও উচ্চ মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, উদাহরণস্বরূপ লেড ক্রোমেটে, যা হলুদের রঙ ও ওজন বাড়াতে ব্যবহৃত হয়।

 

সীসার দূষণের দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি

মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার দূষণ শিশুদের মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, নিস্তেজ হয়ে পড়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, দুর্বল মনোযোগ, ক্ষুধা কমে যাওয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগার কারণ হতে পারে। সীসার বিষক্রিয়া স্নায়বিক প্রক্রিয়া এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা বা আলস্য দেখা দিতে পারে।

যদিও রিসাইকেল কারখানার লোকজন কাঠগোড়া ছেড়ে চলে গেছে, তা সত্ত্বেও অনিককে এখনও সীসার বিষক্রিয়ার পরবর্তী প্রভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে।

“আমি পড়াশোনা করার সময় অনেক কিছু ভুলে যাই,” সে অভিযোগ করে।

তার মা শারমিন আক্তার কৃতজ্ঞ যে, তার ছেলের সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার উৎসটি নির্মূল হয়েছে, তবে তিনি তার স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও উদ্বিগ্ন।

“এখন অনিক কিছুটা ভালো, কিন্তু সীসার ক্ষতি একেবারে যায় না। তার স্মৃতিশক্তিজনিত সমস্যা হচ্ছে,” সে বলে।