নতুন দক্ষতা, নতুন সম্ভাবনা – স্বপ্নপূরনের পথে নতুন যাত্রা
জিপিই ও ইউনিসেফের সহায়তায় ঊর্মি এখন কম্পিউটার পরিচালনা শিখছে এবং নিজের, পরিবারের ও তার কমিউনিটির জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের দক্ষতা অর্জন করছে।

- বাংলা
- English
আধা ঘণ্টা হেঁটে ঊর্মি বাংলাদেশের কক্সবাজারের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পৌঁছায়। সব সময় সে-ই সেখানে প্রথম উপস্থিত হয়। ঊর্মি সেখানে বেশির ভাগ সময় কম্পিউটারে অনুশীলন করে কাটায়।
জিপিই ও ইউনিসেফের সহায়তায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর (বিএনএফই) চালু করা একটি কোর্সে কয়েক মাস আগে যোগ দিয়েছে ঊর্মি। সেখানে কম্পিউটার ও ডিজাইন শিখছে ১৬ বছর বয়সী মেয়েটি। কি-বোর্ডে হাত রেখে তার মনেই হয় না যে সে আবার শ্রেণিকক্ষে (ক্লাশরুমে) বসেছে।

মা, আমি কীভাবে স্কুলে যাব?
ঊর্মির বয়স তখন মাত্র ১২ বছর, এর মধ্যেই অনেক চড়াই-উতরাই পার করে ফেলেছে সে। দুই বছর বয়সে সে তার বাবাকে হারায়। চার বছর পর এক ভূমিধ্বসের ঘটনায় একটি পা হারায় মেয়েটি। সে দেখতে পায়, তিন সন্তানকে বড় করার জন্য তার মা দেলোয়ারা ছাগল পালন করছেন এবং শাক-সবজির চাষ করছেন। তার স্কুলের বেতনটাও পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। তার ওপর, শ্রেণিকক্ষ তার জন্য নিরাপদ জায়গা ছিল না।
ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করার পর ঊর্মি স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়।
“স্কুলে কেউ আমার বন্ধু হতে চাইত না। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলত না। তারা আমাকে নানা কথা বলত,” সেই সব দিনের কথা স্মরণ করে বলে ঊর্মি। সে আরও বলে, “আমার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করা এবং একটি চাকরি পাওয়ার। কিন্তু আমার শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে আমি পারিনি।”
দেলোয়ারা দেখেছেন, তার ছোট মেয়েটি পড়ালেখা শেখা ও কাজ করার প্রতি কতটা আগ্রহী। দক্ষতা অর্জনের বিকল্প কোনো সুযোগ না থাকায় ঊর্মির জীবন থেকে তার স্বপ্ন হারিয়ে যেতে বসেছিল।
“এ সময় আমি অনেক কষ্ট পেতাম। পড়াশোনা করতে পারছে না বলে সে (ঊর্মি) খুব মন খারাপ করত,” বলেন দেলোয়ারা। তিনি বলেন, “ঊর্মি আমাকে জিজ্ঞেস করত, স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীর হাত ও পা আছে। কিন্তু আমার একটি পা নেই। আমি কীভাবে স্কুলে যাব?
কক্সবাজারে মাধ্যমিক শিক্ষার উপযোগী কিশোর-কিশোরীদের প্রতি দুই জনের মধ্যে প্রায় একজনই স্কুলে যায় না। দারিদ্র্য, সামাজিক রীতি-নীতি এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ব্যাহত করে। আর ঊর্মির মতো প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্কুলের যথেষ্ট সহায়তা না থাকায় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।
ফলশ্রুতিতে চিরদিনের জন্য তাদের জীবন বদলে যায়। স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুরা সাধারণত শিশুশ্রমের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে, তাদের বিয়ে হয়ে যায় এবং মাদকের অপব্যবহারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, শিকার হয়ে থাকে নানা ধরনের সহিংসতার।
ঊর্মির ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রতি তার ভালোবাসা কখনও শেষ হয়নি। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হওয়ার পরেও সে বাংলা গল্প পড়তে এবং বিশ্বকে জানতে বন্ধুদের কাছ থেকে গল্পের বই ধার নেয়।
সঠিক উত্তর দেওয়া একমাত্র শিক্ষার্থী
কয়েক বছর কেটে গেছে। তারপর গত বছর ফারুক নামে একজন জরিপকারী ঊর্মির বাড়িতে আসেন এবং তিনি দেলোয়ারা ও ঊর্মিকে জানান যে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরীদের তারা বিনামূল্যে চাকরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
এটা জিপিই ও ইউনিসেফের সহায়তায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো (বিএনএফই) পরিচালিত ‘বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোর-কিশোরীদের জন্য দক্ষতাকেন্দ্রিক স্বাক্ষরতা’ প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোর-কিশোরীদের (১৪ থেকে ১৮ বছর) মধ্যে যারা সবচেয়ে অসহায়, তাদের জন্য। এর লক্ষ্য ওই কিশোর-কিশোরীদেরকে ভবিষ্যতে উৎপাদনক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদেরকে স্বাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞান এবং বৃত্তিমূলক ও জীবনদক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়ে ক্ষমতায়িত করা।
ঊর্মি তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রশিক্ষণে আগ্রহ দেখান।
“ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল, কম্পিউটারে কাজ করা শেখা। সে কারণে আমি কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন এবং গ্রাফিক ডিজাইনিং কোর্সে নাম লেখাই,” বলেন ঊর্মি।
কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ঊর্মির প্রথম দিনে, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি বিভাগের প্রশিক্ষক মাসুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোর-কিশোরীদের স্বাক্ষরতা ও দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তিনি নিজেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এই প্রশিক্ষণে তিনি শিখেছেন, কীভাবে কার্যকর শিক্ষা উপকরণ তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা মূল্যায়ন করা যায়।
শিক্ষার্থীদের অবস্থা কী, সেটা বুঝতে তিনি একটি প্রাক-মূল্যায়নের পরীক্ষা নেন।
“শুধু ঊর্মি সঠিক উত্তরগুলো দিতে পেরেছিল,” স্মরণ করেন মাসুদ।

আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা
তারপর থেকে ঊর্মি নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিয়েছেন এবং নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করেছেন। তিনি কম্পিউটারে টাইপিং, ফটো প্রিন্ট দেওয়া, সিভি তৈরি করা, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন এবং গ্রাফিক ডিজাইনসহ অনেক নতুন দক্ষতা শিখেছেন।

ধঈরে ধীরে, ঊর্মি আত্মবিশ্বাস অর্জন করছেন এবং জিবঙ্কে ন্তুনভাবে উপভোগ করতে পাচ্ছেন। তিনি আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। কোর্সটি শেষ করার পর ঊর্মি একটি কম্পিউটারের দোকান চালু করে তার মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া দক্ষতাভিত্তিক সেবা তিনি অন্যদের কাছেও পৌঁছে দিতে চান।
“এভাবে আমি আত্মনির্ভরশীল হতে পারি,” বলেন ঊর্মি।