বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নবজাতকদের বেঁচে থাকা ও সার্বিক সুস্থতার মান উন্নয়ন
'ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার' কম ওজনের এবং নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেওয়া অপরিণত শিশুদের বেঁচে থাকায় সহায়তা দেয়
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
কম্বলে মোড়ানো এক মাস বয়সী জমজ মেয়েদের দু’হাতে জড়িয়ে রেখে ধলু বলেন, “মধ্যরাত থেকে আমার ব্যথা শুরু হয় এবং রাত ৩টার দিকে আমি কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী জাহেদাকে ফোন করে সন্তান প্রসবের জন্য আমাকে ১৭ নম্বর ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলি। আমি অন্যদের কাছে শুনেছিলাম, ১৭ নম্বর ক্যাম্পের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে (পিএইচসি) সবচেয়ে ভালো সেবা পাওয়া যায়।”
যদিও ধলু তার স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ১৮ নম্বর ক্যাম্পে থাকেন, কিন্তু তিনি ১৭ নম্বর ক্যাম্পের পিএইচসিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পরপরই মেডিকেল অফিসার হুমায়রা ইফতেরকার শাম্মা ও ধাত্রী সুবর্ণা আক্তার সাথী দ্রুত তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন।

“ডাক্তার আমাকে বলেন, আমার গর্ভে জমজ সন্তান রয়েছে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে পাঠানোর দরকার ছিল। কিন্তু তার জন্য আর সময় ছিল না। তাই তারা আমাকে সন্তান প্রসবের জন্য প্রস্তুত করেন এবং রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ আমার ফুটফুটে দুই কন্যাসন্তান মিজান ও সুমাইয়া জন্মগ্রহণ করে। ডা. শাম্মা আমাকে বলেন, আমার দুই মেয়েরই ওজন কম এবং জমজদের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে”- বলছিলেন ২০ বছর বয়সী এই মা।
মিজান ও সুমাইয়া ছিল কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা জমজ, ২০২২ সালের মে মাসের শুরুর দিকে তাদের জন্ম। জন্মের সময় তাদের ওজন ছিল যথাক্রমে ২.১ কেজি ও ১.৩ কেজি। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসা কর্মীরা কোনো সময় নষ্ট না করে দুই নবজাতককে সরাসরি তাদের মায়ের শরীরে সঙ্গে ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ (কেএমসি) পজিশনে এমনভাবে লেপ্টে দেন, যাতে মায়ের ত্বকের সঙ্গে শিশুদের ত্বক লেগে থাকে; যেভাবে ক্যাঙ্গারু তাদের বুকের কাছে রেখে বাচ্চাদের বহন করে। ধলুকে এই কেএমসি কৌশলের সুবিধাগুলো ব্যাখ্যা করে বোঝান ধাত্রী এবং এতে ধলু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
শিশুকে মায়ের ত্বকের সঙ্গে লেপ্টে রাখলে তা শিশুকে উষ্ণ রাখে, শিশুর হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্থিতিশীল করে, মায়ের সঙ্গে শিশুর বন্ধন জোরালো করে এবং মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশে সহায়ক হয়।
“আমাদের এখানে পিএইচসি-তে প্রতি মাসে ৪৫-৫০টি প্রসব হয় এবং প্রতি তিন মাসে আমরা মাত্র এক বা দুটি শিশু পাই, যাদের ওজন জন্মের সময় কম থাকে। এই ধরনের ঘটনায় নবজাতকের যাতে কোনো ধরনের শ্বাসকষ্ট না হয় তা নিশ্চিত করাই থাকে আমাদের অগ্রাধিকার। কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা প্রায়ই কষ্ট পায়। কারণ তাদের চুষে খাওয়ার সক্ষমতা কম থাকে এবং ভালোভাবে বুকের দুধ খেতে পারে না। এর পাশাপাশি ব্লাড সুগার কমে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে”- বলছিলেন ডা. মিজানুর, যিনি এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন।
ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট পিএইচসিকে সম্প্রতি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে উন্নত করা হয়েছে। কেন্দ্রটিতে নিরাময়মূলক যত্ন, টিকাদান ও শৈশবকালীন অসুস্থতা পরিষেবার কমিউনিটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রদান করে। মাতৃসেবার আওতায় সেখানে নবজাতক, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবাসহ প্রসবপূর্ব ও প্রসোবত্তর সেবা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার (জিভিবি) ঘটনা শনাক্তকরণ ও প্রতিকারের জন্য যথাযথ স্থানে পাঠানোর সেবা প্রদান করা হয়।
সেখানে অন্তঃসত্ত্বা, স্তন্যদায়ী নারী ও শিশুদের যারা দেখাশোনা করে তাদের জন্য কাউন্সেলিং সেশন এবং তাদের শিশুদের জন্য একটি খেলার স্থান রয়েছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রে একটি জরুরি সেবার বুথ, সব সরঞ্জামে পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত একটি সন্তান প্রসবের কক্ষ, একটি প্রসবোত্তর ওয়ার্ড ও একটি ল্যাবরেটরি আছে, যেখানে আল্ট্রা-সনোগ্রাম ও অন্যান্য পরীক্ষা করা হয়। এর পাশাপাশি এখানে একটি ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ কক্ষও রয়েছে।
“আমরা যে কেএমসি কৌশলটি প্রয়োগ করি, ইউনিসেফ এবং এর সহযোগীদের অব্যাহত সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব হতো না। তারা আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী যাতে পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করেছে এবং এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে, যা একসময় একটি সাধারণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছিল। আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করতে পেরেছি, কারণ আমরা এই পদ্ধতির জন্য ভালোভাবে প্রশিক্ষিত”- বলেন ডা. মিজানুর।

সাধারণত, কেএমসি পদ্ধতি বুকের দুধ খাওয়ানোকে উৎসাহিত করে। এটি মায়ের ওপর চাপ কমায় এবং তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে মাকে সক্ষম করে তোলে। কেএমসি কৌশল প্রচলিত নবজাতকের যত্নের একটি নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বিকল্প, যা নবজাতকের অসুস্থতা ও মৃত্যুহার কমাতে পারে এবং বিশেষ করে জন্মের পরের প্রথম কয়েক ঘণ্টায় শিশুর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
এক মাস পর মিজান ও সুমাইয়ার ওজন এখন যথাক্রমে ৩ কেজি এবং ২.৫ কেজি। ধলু ও তার স্বামী সঠিক পুষ্টি, বুকের দুধ খাওয়ানো, প্রসব-পরবর্তী যত্ন, স্বাস্থ্যবিধি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে পরামর্শ ও উপদেশ পেয়েছেন।
ধলু বলেন, তার এলাকার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা (সিএইচডব্লিউ) অনেক সাহায্য করেছেন। সিএইচডব্লিউ-রা একটি শক্তিশালী বাহিনী, যারা সফলভাবে রোগীদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করছেন।
১৮ নম্বর ক্যাম্পে কর্মরত সিএইচডব্লিউ জাহেদা খাতুন বলেন, “আমরা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তাদের গর্ভাবস্থার পুরো সময় পরামর্শ দেই। তাদের যেসব সেবা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে আমরা তাদের অবহিত করি। প্রয়োজনের সময় তাদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে আসি, এমনকি যদি তা মাঝরাতেও হয়। আমরা তাদের প্রসবপূর্ব যত্ন (এএনসি) সংক্রান্ত পরামর্শ দেই, তাদের টিকাদান পর্যবেক্ষণ করি এবং তাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার ও কম কাজ করার কথা মনে করিয়ে দেই। এটা আমার কাছে দারুণ একটি কাজ– নারীদের মা হতে সাহায্য করা এবং আমি নিজে একজন মা হওয়ার কারণে মা হওয়ার যে কী আনন্দ তা বুঝতে পারি।”
রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দাতা কমিউনিটির স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য অব্যাহতভাবে সহায়তার প্রদান করায় বাদশাহ সালমান মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ কেন্দ্রের (কেএস রিলিফ) প্রতি ইউনিসেফ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।