বন্ধুত্বের মাধ্যমে উদ্বেগ দূর হচ্ছে কক্সবাজারের কিশোরীদের
রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশি মেয়েরা ফুটবল খেলার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করছে
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
বাংলাদেশের কক্সবাজারের প্রচণ্ড গরমে রুমা খালি পায়ে দক্ষতার সঙ্গে মাঠজুড়ে ছোটাছুটি করে। মাঠটি ফুটবল মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে এটি একটি প্রকৃত ফুটবল মাঠের আকারের অর্ধেক এবং গোলপোস্টগুলোও তেমনই। মেয়েদের কাউকেই অবশ্য গরম, তাদের খালি পা বা মাঠের আকার নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হয় না! তারা দারুণ সময় কাটাচ্ছে।
রুমা অনায়াসেই একটি গোল করে। তার দলের খেলোয়াড়রা ভীষণ উল্লাসে মেতে ওঠে, আর অন্য দল থেকে আসে প্রতিবাদ। "এটা অফসাইড," বলে দাবি করে প্রতিপক্ষ দলের অঘোষিত অধিনায়ক শামসুনা। গোলটি বাতিল হয় এবং খেলা চলতে থাকে। কিন্তু রুমা বিরক্ত হয় না। "আমি আরেকটি গোল করব," বলে সে হাসে এবং চলে যায়।
নিজের কথা ঠিক রেখে শেষ বাঁশি বাজার আগে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেওয়া দুই গোলের জবাবে সে তিন গোল দেয় এবং দিনটি নিজের করে নেয় তার দল। সে এবং তার দল প্রীতি ফুটবল টুর্নামেন্টের বিজয়ী।
রুমার জন্য একটি সাপ্তাহিক পুরস্কার
ফুটবল এবং যে সোশ্যাল হাব বা সামাজিক কেন্দ্রে তারা খেলাধুলা করে সেখানে কাটানো দিনগুলো রুমার সপ্তাহের সেরা দিন। এটি অন্যান্য রোহিঙ্গা মেয়েদের ক্ষেত্রেও সত্য, যারা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এই সোশ্যাল হাবে যায়।
“আমি এটি পছন্দ করি, কারণ আমরা ভিন্ন কমিউনিটি থেকে এখানে এসে বন্ধুত্ব করতে পারি। আমরা শিশুবিয়ের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কীভাবে অন্যদের সঙ্গে ভালোভাবে বাঁচতে হয় সে সম্পর্কে শিখি। সবচেয়ে বড় কথা আমি ফুটবলও খেলতে পারি,” বলে রুমা।
১৫ বছর বয়সী রুমা একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে সে। নিপীড়ন থেকে বাঁচতে রুমা ও তার পরিবার নিরাপত্তার জন্য আরও কয়েক হাজার শরণার্থীর সঙ্গে কষ্টকর যাত্রায় সামিল হয়েছিল। আগের দফায় বাস্তুচ্যুতির পর বাংলাদেশে অবস্থান নেওয়া ৩ লাখ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয় তারা। এখন প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী, যাদের অর্ধেক শিশু, বসবাস করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শরণার্থীশিবিরে।,
রুমা আরও বলে, "একজন মেয়ে হিসেবে, আমি বাড়িতে আমার ভাইদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পারি না। তবে আমি সবসময় তাদের খেলতে দেখি, যাতে আমি কিছু কৌশল শিখতে পারি এবং সামাজিক কেন্দ্রে আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় তা কাজে লাগাতে পারি।"
আর বিস্তীর্ণ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ইউনিসেফের সহায়তায় তৈরি সামাজিক কেন্দ্রে তাকে সেরা ফুটবলার বানিয়েছে।
অপরপক্ষ যেভাবে জীবনযাপন করে তার প্রশংসা করা
সোশ্যাল হাবগুলো ক্যাম্পের সীমান্তে অবস্থিত এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশাপাশি আশেপাশের কমিউনিটির বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিনোদনের সুযোগ তৈরি করেছে। দুই কমিউনিটির মধ্যে বন্ধুত্ব এবং বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করার জন্যই এগুলো বানানো হয়েছে।
তবে এখনও বন্ধুত্ব তেমন গাঢ় না হলেও রুমা সবসময় ফুটবল খেলতে এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির আরেক বড় ফুটবলার শামসুনের মতো দক্ষতা অর্জনের জন্য উন্মুখ থাকে। এই মুহূর্তগুলো বিরল ও মূল্যবান। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশি মেয়েরা একে অপরের সঙ্গে ফুটবল খেলছে, একে অপরের বিরুদ্ধে নয়। দুই কমিউনিটির মধ্যে সাধারণত উদ্বেগ বেশি থাকে, তবে সামাজিক কেন্দ্রগুলোই একমাত্র জায়গা যেখানে এই দুই কমিউনিটির শিশুদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটে।
১৭ বছর বয়সী শামসুনা বলে, "সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি আমি শিখেছি তা হলো অন্যদের সঙ্গে তাদের অবস্থা বুঝে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচতে হয়।"
সামাজিক কেন্দ্রে, শামসুনা গল্প বলার সেশনটিও উপভোগ করে, যেখানে তারা একে অপরের জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে পারে।
“এই জায়গাটি দারুণ। এটা আমাদের শেখায় কীভাবে একসঙ্গে থাকতে হয় এবং একে অপরের বন্ধু হতে হয়,” ব্যাখ্যা করে শামসুনা।
২০২২ সালে, রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয়দাতা উভয় কমিউনিটির ৪২ হাজারের বেশি কিশোর-কিশোরী ও তরুণ কক্সবাজারে ছয়টি সামাজিক কেন্দ্রে সহাবস্থানের জায়গা খুঁজে পায়।
বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া এবং বর্তমানে শরণার্থী শিবিরে জনাকীর্ণ পরিস্থিতিতে বসবাস করা রুমার মতো শিশুরা শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে ইউনিসেফ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে সহায়তা করে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর সুরক্ষা উন্নত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে।
এই ইউনিসেফ প্রোগ্রাম KfW এর মাধ্যমে জার্মান সরকার সহায়তায় পরিচালিত।