পরীক্ষার কিট সরবরাহের মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবিলা জোরদারকরণ
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনা

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
বারো বছর বয়সী সৌরভ দুই দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিল। বাড়িতে রেখে চিকিৎসা ও যত্ন প্রদানে তার মায়ের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সৌরভের অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছিলনা । পরে তার বাবা-মা তাকে গাজীপুরের টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করালে সৌরভের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তাৎক্ষণিক তাকে এই হাসপাতালেই ভর্তি করা হয়।
একটি স্বাস্থ্য সংকট সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ
শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ ডা. আনজুম আরা বেগম বলেন, “ লোকবল সংকট আমাদের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটগুলোর নিয়মিত সরবরাহ বজায় থাকায় আমরা আমাদের রোগীদের সময়মত রোগ নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারছি। এতেই আমরা সন্তুষ্ট।
বাংলাদেশ ডেঙ্গুর সবচেয়ে মারাত্মক প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করছে। দেশের ৬৪টি জেলা থেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত ও চিকিৎসা প্রদান করা না গেলে শিশুদের অবস্থার খুব তাড়াতাড়ি অবনতি ঘটতে পারে। তবে অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার পর্যাপ্ত কিট না থাকায় সময়মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইউনিসেফ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সিডিসি (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) মাধ্যমে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালসহ সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট সরবরাহ করেছে।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যেই শনাক্তকরণ পরীক্ষার দ্বারা নিশ্চিত হয়ে ৪৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু এই হাসপাতালে ভর্তি হয়; তাদের মধ্যে একজন সৌরভ। ডেঙ্গু-আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এই হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু-আক্রান্ত গুরুতর শিশুদের জন্য বিশেষ ইউনিটে পরিণত করা হয় যেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। অবস্থার উন্নতি হলে তাদের সাধারণ ডেঙ্গু ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটি পরিবার
পাঁচ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সৌরভ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার মতো অবস্থায় উন্নীত হয়। দিনটির জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল সে। হাসপাতালে থাকার সময়ে কোন বিষয়টির অভাব সবচেয়ে বেশি বোধ করেছে জানতে চাইলে সৌরভ বলে, “আমি স্কুলে যাওয়ার এবং ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মিস করেছি।’’ সৌরভের মা জানায়, সে স্কুলে যেতে খুব পছন্দ করে এবং কখনোই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে না। তবে ডেঙ্গুর কারণে এক সপ্তাহ সে স্কুলে যেতে পারেনি।
সৌরভের মা একজন পোশাককর্মী। সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ ধরে তিনি ছুটিতে আছেন। তিনি বলেন, “আমি ছুটি নিতে পেরেছি। তবে আমার কর্মস্থল থেকে বারবার ফোন করে আমাকে কাজে ফিরতে বলছে। সৌরভ যাতে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে তা নিশ্চিত করতে আমাকে আরও অন্তত দুই দিন তার সঙ্গে বাড়িতে থাকতে হবে। কেননা সে এখনও দুর্বল বোধ করছে।”
তাদের বাড়ির কাছেই সৌরভের বাবার একটি ছোট দোকান রয়েছে। সৌরভ হাসপাতালে থাকার পুরোটা সময় দোকানটি বন্ধ ছিল। কেননা সৌরভের বাবার অবর্তমানে দোকানটি চালানোর মতো আর কেউ নেই। আর এতে তাদের বেশ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সৌরভের বাবা মো. স্বপন বলেন, “আমার ছেলে যাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতালে তার সঙ্গে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।”
ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে পরিবারটির নেওয়া পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌরভের মা বলেন যে তিনি তাদের বাড়ি সবসময় পরিষ্কার রাখেন ও কোথাও যেন পানি জমে মশার বংশবিস্তার হতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক থাকেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে সৌরভ অসুস্থ হওয়ার পরেই কেবল তারা মশারি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এখন, ঘুমানোর সময় মশারি টাঙানোকে অভ্যাসে পরিণত করেছেন তারা। ডেঙ্গু থেকে পরিবারকে রক্ষায় ভবিষ্যতেও এই অভ্যাস ধরে রাখবেন বলে জানান পরিবারটি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা
ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠতে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে এরোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সময়মত চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডেঙ্গু সংকট শুরু হওয়ার পর, ইউনিসেফ ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট, যার দ্বারা ১২৬,০০০ টিরও বেশিবার পরীক্ষা করা সম্ভব, ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করেছে। তাছাড়া, স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান এবং মশার প্রজননক্ষেত্রগুলো পরিষ্কার রাখার জন্য প্রচারণা, কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা, ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মতো পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করছে।

শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পরীক্ষার কিট সরবরাহে ইউনিসেফের সহায়তা পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়ক হয়েছে। তাদের সময়োপযোগী এই সহায়তা আমাদের কমিউনিটির জন্য এক জীবনরক্ষার কাজ করেছে। এমন একটি সংকটের সময়ে পাওয়া কিটগুলো আমাদের ডেঙ্গু পরীক্ষার চাহিদা মেটাতে সাহায্য করছে।” তিনি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে কমিউনিটির ক্ষমতায়নে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য ইউনিসেফকে ধন্যবাদ জানান।
তবে তিনি সতর্ক করেন, যদি বর্তমান পরিস্থিতি আরও ২-৩ মাস অব্যাহত থাকে, তাহলে অতিরিক্ত সহায়তা ও নতুন আরও কিটের সরবরাহ অপরিহার্য হয়ে উঠবে। অন্যথায় হাসপাতালে এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখনও চলমান; বাড়ছে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের চাহিদা। ইউনিসেফ তাই সিডিসিকে (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) প্রয়োজন অনুযায়ী আরও কিট সরবরাহ করবে। ঝুঁকিপূর্ণ কমিউনিটির ওপর, বিশেষ করে শিশুদের ওপর, ডেঙ্গুর প্রভাব প্রশমনে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ সরকার ও অংশীজনদের সঙ্গে একসাথে কাজ করতে ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতবদ্ধ। সরকারি অংশীজন, ইউনিসেফের মতো সংস্থাসমূহ ও কমিউনিটির মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি পরিবার পর্যায়ে দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যতে এর সংক্রমণ ঠেকাতে সহায়ক হয়ে উঠবে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাদের অবদানের জন্য ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়।