ঢাকা দক্ষিণের বিদ্যালয় বহির্ভুত শিশুদের প্রত্যাশা এবং স্বপ্নপূরণের প্রথম বছর
এএসিটি এবং ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগ বিদ্যালয় বহির্ভুত শিশুদের শিক্ষায় পুনঃপ্রবেশের দ্বার উন্মোচন করেছে

- বাংলা
- English
ঢাকার কোলাহলপূর্ণ অলি-গলি-রাজপথে যখন প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য সহনশীলতা এবং আশার গল্পগাঁথা, ঠিক সেসময় একটি যৌথ উদ্যোগ হাজারো শিশুর জীবনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে নিরবে-নিভৃতে গত একবছর ধরে নিরলস কাজ করে চলেছে। বিদ্যালয় বহির্ভুত শিশুদের শিক্ষার অধিকার পূরণের লক্ষ্যে আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ইউনিসেফ বাংলাদেশ এবং আঞ্জুমান এন্ড আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট (এএসিটি) হাতে হাত মিলিয়েছিল, নিয়েছিল এই যৌথ উদ্যোগ।
বিগত একবছরে এই যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিদ্যালয় বহির্ভুত হাজারো শিশু এবং স্থানীয় কমিউনিটিতে যে পরিবর্তনের আবহ তৈরি হয়েছে, তা অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।
আলোর হাতছানি
এই যৌথ উদ্যোগের মূলে রয়েছে ইউনিসেফের অ্যাবিলিটি বেইজড অ্যাকসিলারেটেড লার্নিং (এবিএএল) নামক শিক্ষাপ্রদানের এক প্রোগ্রাম। ৮-১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয় বহির্ভুত শিশুদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা, তাদের চাহিদা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সর্বোপরি সামগ্রিক উপযোগিতার কথা মাথায় রেখে এই প্রোগ্রামটি তৈরি করা হয়েছে। নমনীয় এই প্রোগ্রামের মূল কথা হলো শিশুদের জন্য এমন একটি শিখন পরিবেশ তৈরি করা যাতে শিশুরা নিজস্ব গতিতে শিক্ষা অর্জন করে নিজেদের পুনরায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত করতে পারে।প্রতিটি শিশুর নিজস্ব চাহিদা এবং সক্ষমতার বিষয়কে মাথায় রেখে ইউনিসেফ এবিএএল নামক যে শিক্ষা প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তা শিশুর শেখার ক্ষেত্রে কার্যকরি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে যে সকল শিশুরা শিক্ষার সুযোগ লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের শিক্ষা প্রদানের জন্যে এবিএএল প্রোগ্রামটি খুবই কার্যকরি। শেখার প্রতি ভালোবাসা পুনর্জাগরণের মাধ্যমে এই শিক্ষা প্রোগ্রামটি বিদ্যালয় বহির্ভুত শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ফিরে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইউনিসেফ ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য এবং আঞ্জুমান অ্যান্ড আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান জানেন শিক্ষার শক্তি মানুষের জীবন কতটা বদলে দিতে পারে। এই যৌথ উদ্যোগের তাৎপর্য এবং এবিএএল প্রোগ্রামের গুরুত্ব অনুধাবন করে মিঃ খান বলেন, "আমরা এবিএএল প্রোগ্রামকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে একটি যৌথ উদ্যোগের সূচনা করেছি যাতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষার মূলধারায় ফিরে আসে এবং তাদের সমবয়সীদের সমান শিক্ষা পায়। এর ফলে সমাজে সমতা বিরাজ করবে। আমরা বিশ্বাস করি সমাজে সমতায়নের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব অপরিসীম।" এর মাধ্যমে তিনি মূলত: সমাজের বিত্তশালীদের শিক্ষায় বিনিয়োগের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
একটি উপলব্ধিময় ভ্রমণ
এই যৌথ উদ্যোগের অর্জন সরোজমিনে দেখার জন্য গত ১৭ ই অগাস্ট মিঃ খান কামরাঙ্গীরচরের নিকটবর্তী ঝাউচরে ইউনিসেফের একটি শিখন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তার সাথে ছিলো তার পরিবার এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের চিফ অফ এডুকেশন দীপা শংকরের নেতৃত্বে ইউনিসেফ প্রতিনিধি দল।

সুবিধাবঞ্চিত কিন্তু প্রাণচঞ্চল একদল শিশু মিঃ খান এবং তার সংগীদের আকুন্ঠ ভালোবাসায় বরণ করে নেয়। কঠিন দুর্দশার মাঝেও হাল ছেড়ে না দেয়া এইসব শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ মুগ্ধ করে সকলকে। শিক্ষকের সহায়তায় একদিকে শিশুরা যেমন তাদের পড়ালেখার অগ্রগতি দেখায়, ঠিক তেমনি মিঃ খান শিশুদের সাথে পাঞ্জা লড়ে, সকলের সাথে সমস্বরে গান গেয়ে, কারও মুখ থেকে কবিতা শুনে এবং নিজে কবিতা বলে নিজেকে নামিয়ে নিয়ে আসেন শিশুদের সমপর্যায়ে, হয়ে উঠেন শিশুদের বন্ধু। শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সবাইকে বুঝিয়ে দেয় পড়ালেখার প্রতি তাদের প্রবল আগ্রহ এবং ভালোবাসা। নির্মল আনন্দ, প্রাণোচ্ছল হাসি এবং অপরিসীম ভালোবাসার মাধ্যমে শিশুদের সমপর্যায়ে নেমে এসে মিঃ খান শিশুদের অনুপ্রাণিত করেন সকল প্রতিকূলতার মাঝে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার, সুবিধাবঞ্চিত এইসব শিশুদের হৃদয়ে বুনে দেন ভবিষ্যতে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন।
কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) সাথেও বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন মি: খান। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বাবা-মা এবং স্থানীয় কমিউনিটিকে উৎসাহিত করা – যাতে শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য তারা সকলে মিলে একসাথে কাজ করতে পারে৷ মি: খান তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, "এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শেখার প্রতি আগ্রহ এবং পড়াশুনা চালিয়ে যাবার দৃঢ়সংকল্প আমাকে বিস্মিত করেছে। এতো প্রতিকূলতার মাঝেও বুকে অফুরন্ত সাহস রেখে তাদের পড়াশোনা, তাদের শিক্ষা অব্যহত রাখার এই প্রচেষ্টা আমাকে বিমোহিত করেছে।"
আশার আলো
প্রাণবন্ত এই ক্লাসরুমে মি: খান কিছুক্ষণ কথা বলেন ১০ বছর বয়সী কুলসুমের সাথে, যার জীবনে একরাশ হতাশার মাঝে উজ্বল আশার আলো জ্বালিয়েছে এই এবিএএল প্রোগ্রাম।

বাবা-মা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর কুলসুম এখন তার নানীর সাথে থাকে। কুলসুম প্রতিদিন ইউনিসেফের এই শিখনকেন্দ্রে ক্লাস করতে আসে। গত চার মাস ধরে কুলসুম শিক্ষার আলোয় প্রজ্জলিত হয়ে আনন্দের সাথে শিখছে এবং ক্লাসের বন্ধুদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে গভীর আনন্দে উপভোগ করছে। একরাশ উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল চোখ নিয়ে সে বলেছিলো, “আমি ইংরেজি এবং গণিত শিখতে, এবং এই সেন্টারে এসে ক্লাস করতে খুব পছন্দ করি।
এবিএএল প্রোগ্রাম কুলসুমকে দিয়েছে শেখার সুযোগ, নতুন কিছু বন্ধু এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। শিক্ষা কিভাবে শিশুদের জীবন বদলে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো কুলসুম। কুলসুমের গল্প প্রমাণ করে যে তার মতো শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পেলে সফল হতে পারে, এগিয়ে যেতে পারে উন্নতির পথে ।
সকল শিশুর ক্ষমতায়ন
কামরাঙ্গীরচরের নিকটবর্তী ঝাউচরের এই কেন্দ্রটি ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৬৭টি কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম। এএসিটি এবং ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত এই ৬৭টি শিখনকেন্দ্র, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৩,০০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকের জন্যই আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবিএএল প্রোগ্রামের প্রতি এএসিটি এবং ইউনিসেফ-এর অটল প্রতিশ্রুতি এইসকল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার পথ উন্মোচিত করেছে।

“ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারী ৩,০০০ শিশুর শিক্ষার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টায় এএসিটি-এর অংশীদারিত্বের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। শিশুদের শিক্ষার অধিকার পূরণের জন্য এই ধরনের অংশীদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ” বলেছেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের চিফ অফ এডুকেশন দীপা শংকর।
এএসিটি এবং ইউনিসেফ মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি শিশুকে ক্ষমতায়িত করার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে করে সকল শিশু ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য সমান সুযোগ পায়। এএসিটি এবং ইউনিসেফের দ্বিপাক্ষিক অংশীদ্বারিত্বের প্রথম বছর এটাই প্রমান করে যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, প্রতিশ্রুতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে শিশুদের জন্য উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। এবিএএল কর্মসূচী ঢাকা দক্ষিণের এই শিশুদের উন্নতি এবং সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার আশা জোগাচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে, এই শিশুদের স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে, এবং তাদের ভবিষ্যত রূপান্তরিত হচ্ছে।