কোভিড-১৯ এর কারণে বন্ধ থাকা স্কুল খোলার পর ১০ বছর বয়সী সোহানা আবার পড়তে শেখে
ক্যাচ-আপ ক্লাসগুলো পিছিয়ে পড়া শিশুদের দ্বিতীয়বার সুযোগ করে দেয়

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ১০ বছর বয়সী সোহানার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তার বড় ভাইবোনদের চেয়ে অনেক ভালো। এক সময় তাদের স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সোহানা একটি বড় জীবনের স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ময়মনসিংহে ছোট্ট গ্রামের বাড়িতে যে অবস্থায় থাকে তার চেয়ে অনেক বড় জীবনের স্বপ্ন দেখে সে।
"আমি একজন চিকিৎসক হতে চাই," সোহানা বলে।
বাংলাদেশ এবং এর বাইরে অনেক শিশুর মতো কোভিড-১৯ মহামারির সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সোহানার পড়াশোনা ব্যাহত হয়। মহামারির কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে সোহানার মনে হতো, সে স্কুলে যা শিখেছে সব ভুলে গেছে। অবশ্য করোনার কারণে বিশ্বে এটিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার ঘটনা।
একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ
বাংলাদেশে স্কুল বন্ধ হওয়ার সময় সোহানা দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল এবং মহামারির বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর চতুর্থ শ্রেণিতে উঠবে বলে আশা করা হয়েছিল। করোনা মহামারির বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর শিশুরা যখন স্কুলে ফিরে যায় তখন তাদের মধ্যে পড়াশোনার ঘাটতির বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট ছিল। সোহানার শিক্ষক বলেন, যে সময় শিশুদের বাক্য তৈরি করা শেখার কথা তখন তাদের পুনরায় বর্ণমালা শিখতে হয়েছিল। সোহানার মতো অনেকেই স্কুল পুনরায় খোলার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে ফিরে যায়নি। এমন ঘটনা তাদেরকে সহপাঠীদের তুলনায় আরও পিছিয়ে দেয় এবং আর কখনও স্কুলে ফিরতে না পারার ঝুঁকিতে ফেলে।
সোহানার বাবা নির্মাণ প্রকল্প ও খামারে কাজ খোঁজেন। অন্যদিকে তার মা আম্বিয়া বাড়িতে রান্না ও ধোঁয়ামোছা এবং নিজের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করেন। বাড়িতে কোনো কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ডিভাইস না থাকায় ১০ বছর বয়সী সোহানার জন্য অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে অর্থের অভাবে তার পরিবার একজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি।
পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ফরেইন কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস এর অর্থায়নে ইউনিসেফের একটি ক্যাচ-আপ প্রকল্প শিশুদের স্কুলে এবং তাদের বয়স অনুপাতে জ্ঞানার্জনের যথাযথ স্তরে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করছে। ক্যাচ-আপ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সোহানার পড়া ও লেখার উন্নতি হয়েছে। সে সকালে ইউনিসেফের একটি শিক্ষাকেন্দ্রে যায় এবং বিকেলে তার নিয়মিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাসে অংশগ্রহণ করে।
সোহানার মা বলেন, যদিও তিনি নিজে পড়তে পারেন না, তবে তিনি তার মেয়ের জন্য ভিন্ন জীবন চান এবং শিক্ষাকেন্দ্রে তার মেয়ের উন্নতিতে তিনি খুশি। আম্বিয়ার লক্ষ্য ছিল তার সব ছেলেমেয়েই স্কুলে যাবে, কিন্তু তার বড় সন্তানরা যখন বেড়ে উঠছিল তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। পরিবারের চাহিদা মেটাতে তাদের ছোটবেলায় স্কুল ছাড়তে হয় এবং কাজ শুরু করতে হয়।
“সোহানা এখন আমাদের ভরসা। আমি তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করি এবং যতটুকু পারি তাকে সমর্থন দেই। আমি তার স্কুলে বাবা-মায়েদের বৈঠকে যাই,” বলেন সোহানার মা।
শিক্ষার সংকট মোকাবিলা করা
কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতের আগেও বাংলাদেশে একটি "শিক্ষার সংকট" ছিল। ২০১৭ সালের মূল্যায়ন অনুসারে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির অর্ধেকেরও কম শিশু পড়তে পারা ও গাণিতিক সমস্যা সমাধানে দক্ষ ছিল। ২০২১ সালের একটি শিক্ষা জরিপে মহামারির পরেও শিক্ষার সংকট অব্যাহত থাকার বিষয়টি উঠে আসে, তবে শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতির বিষয়টি নেই।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিক্ষা প্রধান দীপা শংকর বলেন, “এর অর্থ হচ্ছে, মহামারির আগে থেকেই যেসব শিশু পিছিয়ে ছিল – সেই শিশুরা যারা সবচেয়ে দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে, যাদের বাড়িতে কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা টেলিভিশনের মতো সহায়ক ডিভাইসের অভাব রয়েছে এবং যাদের বাবা-মায়েরাও স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিল – সেসব শিশুই মহামারিজনিত স্কুল বন্ধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।"
জরিপে আরও উঠে এসেছে, সোহানার বাড়ি যেখানে সেই ময়মনসিংহে দূরশিক্ষণ ক্লাসে শিশুদের অংশগ্রহণের হার ছিল সবচেয়ে কম, ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে ঢাকায় এই হার ২৩ দশমিক ১ শতাংশ।
ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট শিক্ষাকেন্দ্রে শিশুরা তাদের দক্ষতার স্তর অনুযায়ী আলাদা রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা গ্রুপে বসে। এতে শিক্ষক শিশুদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান। শিশুরা পরবর্তী স্তরে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আরেকটি গ্রুপে চলে যায়। আর এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না তারা সফলভাবে ক্যাচ-আপ প্রোগ্রামটি সম্পন্ন করতে পারে।
শিশুদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে স্কুলে ফিরতে সাহায্য করা
ক্যাচ-আপ ক্লাসগুলো এমনকি মহামারিজনিত স্কুল বন্ধের প্রভাবের বাইরেও কার্যকর। যদিও বাংলাদেশ চমকপ্রদভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় সর্বজনীন আওতার কাছাকাছি অবস্থা অর্জন করেছে, প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার বয়সী শিশুদের ৯৭ শতাংশই স্কুলে যায়, তবে অনেক শিশু প্রকৃতপক্ষে স্কুলে উপস্থিত হয় না। প্রায় ১৭ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে।
ইউনিসেফ ও ফরেন কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস ক্যাচ-আপ প্রোগ্রামের মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের বয়স অনুপাতে সাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দেয়।
শিক্ষাকেন্দ্রে যে সহায়তা পাচ্ছে তাতে সোহানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার নিয়মিত ক্লাসে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হয়েছে। সে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে এবং নিজের ও তার পরিবারের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। স্কুলে তার প্রিয় বিষয় বাংলা এবং সে এখন অক্ষর ও শব্দ মিলিয়ে বাক্য পড়তে সক্ষম, যা তাকে পুনরায় শিখতে হয়েছে।##