কক্সবাজারে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় হাইজিন সচেতনতা বৃদ্ধিতে দূতের ভূমিকায় রোহিঙ্গা শিশুরা
গল্প, গান ও মজার মধ্য দিয়ে হাত ধোয়া ও জীবাণুর মধ্যকার সম্পর্ক শিখছে শিশুরা

- বাংলা
- English
“১২ বছরের মেয়ে নূর আন্না তার পরিবারের জন্য কলা তৈল তরকারি (সবুজ সবজির একটি তরকারি) রান্না করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু খাবারটি তৈরির আগে হাত না ধোয়ায় তার পুরো পরিবার অসুস্থ হয়ে পড়ল,” বলেন বন্দনা রানী দাশ, যিনি ইউনিসেফের পার্টনার কেয়ার-এর হাইজিন প্রমোটার হিসেবে কাজ করছেন।
“এই দুর্ভাগ্য এড়াতে সে কী করতে পারত?” হাত ধোয়া নিয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির একটি সেশনে এই প্রশ্ন করলেন বন্দনা।
সমস্বরে জবাব দিল শিশুরা। তাদের উত্তরগুলোর সুত্র ধরে হাত ধোয়া ও জীবাণু ঘিরে একটা বৃহত্তর আলোচনার অবতারণা হোল।
“বাস্তব জীবনের নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে আমরা এদের শেখাচ্ছি। খেলাধুলা ও নাটক-কাহিনীর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য ও হাইজিন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলো এমনভাবে তুলে ধরছি যাতে শিশুরা বুঝতে পারে। এটাকে বলে ‘লার্নিং থ্রু লাফটার’ (হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শেখা)। শিশুরা যখন শিক্ষায় আনন্দ পায়, তখনই তাদের সেগুলো মনে রাখার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং নিজেদের জীবনে তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলো অনুসরণ করে,” বলেন মাকসুদা সুলতানা, যিনি ইউনিসেফের পার্টনার কেয়ার-এর হাইজিন প্রমোশন বিষয়ক টেকনিক্যাল ম্যানেজার।
“তারা দারুণভাবে সমাজে বার্তা ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখে। সে কারণে কমিউনিটিতে তাদের নেতৃত্বস্থানীয় জায়গায় নিয়ে যেতে আমাদের সহায়তা করাটা গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন তিনি।

পথ দেখাচ্ছে শিশুরা
হাত ধোয়া সম্পর্কিত আচরণ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিশুদের ভুমিকার কথা স্বীকার করে ইউনিসেফ। কক্সবাজারে শিশুদের জন্য হাত ধোয়াকে মজার বিষয়ে রূপ দিতে ইউনিসেফ একটি উদ্ভাবনী কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে, যেখানে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় হাইজিন সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় তাদেরকে কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
এক্ষেত্রে মোহাম্মদ জিয়ান চমৎকার কাজ করছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিবার, বন্ধু ও কমিউনিটিতে হাত ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত জ্ঞান বিনিময়ের জন্য যে ১ হাজার ৬০৩ জন শিশুকে (৭৭৯টি মেয়ে ও ৮২৪টি ছেলে) ইউনিসেফের অংশীদাররা তৈরি করেছে সে তাদের একজন।
কমিউনিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিপূর্ণ হাইজিন অভ্যাস গড়ে তুলতে নিজেদের উদ্যোগী হওয়ার জন্য প্রতিটি শিশু ১০ জন মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলো পৌঁছে দিচ্ছে।
কোভিড-১৯ কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে শিক্ষকদের একটি প্রশ্নের জবাবে জিয়ানের প্রবল উৎসাহের প্রতিফলন ঘটে। সে এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দেয় যে, তার বয়স যে মাত্র ১২ বছর তা মানতে কষ্ট হয়।
“করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কাজ করতে হবে। আমাদের ঘন ঘন সাবান ও হ্যান্ড রাব দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত পরিষ্কার করতে হবে। আমি আপনাদের দেখাচ্ছি ১, ২, ৩…,” বলে যথাযথভাবে হাত ধোয়ার পদ্ধতি দেখানোর পাশাপাশি ২০ পর্যন্ত গণনা করে সে।
“দ্বিতীয়ত, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকতে হবে আমাদের বা টিস্যু ব্যবহার করতে হবে। টিস্যু না থাকলে পরে আপনার হাত ধুয়ে নিতে হবে।
“এবং তৃতীয়ত, আমাদের একে অপর থেকে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে যেমনটি এখন আমি আপনাদের দেখাচ্ছি,” বলে হাত প্রসারিত করে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম দূরত্ব ইংগিত করে সে।
মোহাম্মদ জিয়ান বলে, “প্রতিটি ব্লকের শিশুরা এখানে শিখতে আসে। আমাদের বন্ধু তৈরিরও একটা সুযোগ হয়েছে এখানে। আমাদের শিক্ষকরা সত্যিই আমাদের ভালোবাসেন এবং আমরা এখানে আনন্দ পাই।”
কক্সবাজারে ইউনিসেফের হাইজিন প্রমোশন স্পেশালিস্ট সিলভিয়া রামোস বলেন, “এই শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঠিকমতো হাত না ধোয়া এবং ছোট শিশুদের পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় ভোগা ছিল নিয়মিত ঘটনা।
“হাত ধোয়াকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করার জন্য শিশুদের সহযোগিতার লক্ষ্যে আমাদের দরকার ছিল একটি টেকসই ও পদ্ধতিগত কর্মপন্থা।”

ভিত্তি তৈরি করা
ইউনিসেফের অংশীদাররা বিগত এক বছর ধরে সর্বোত্তম উপায়ে হাত ধোয়া শেখানো, এ বিষয়ে আচরণগত পরিবর্তনে উৎসাহী করা এবং কমিউনিটি, বিশেষত শিশুদের হাতধোয়া নিয়ে সচেনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার জন্য যোগ্য করে তুলতে কাজ করে আসছে।
সিলভিয়া বলেন, “আমরা বিগত বছর হাত ধোয়া সম্পর্কিত আচরণগত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ প্রারম্ভিক কাজ করেছি, যা এখন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে ।”
কোভিড-১৯ জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভয়ানক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এসব শিবিরে ৮ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থী রয়েছে, যাদের অর্ধেকই শিশু। গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০ হাজার শরণার্থী বসবাস করছে, যা তাদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাবের উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করেছে।
অভিন্ন টয়লেট, গোসলখানা ও টিউবওয়েলের মতো পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও হাইজিন অবকাঠামোগুলো অনেকে মিলে ব্যবহার করায় জটিলতা ও চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেড়ে যায়।
সিলভিয়া বলেন, “কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সুরক্ষায় সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সবচেয়ে ভালো উপায়গুলোর একটি। হাইজিন যাতে আরও বেশি মেনে চলা হয় সেজন্য আমরা কর্মতৎপরতা সম্প্রসারণ করছি এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধা বাড়াচ্ছি।
“যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার মধ্য দিয়েই কোভিড-১৯ কে পরাজিত করা না গেলেও তা এই রোগ প্রতিরোধের একটি সুযোগ তৈরি করে। এখন আমরা হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরিতে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি নজর দিচ্ছি। আমরা আমাদের ছোট দূতদের নিয়ে গর্বিত, যারা নিজেদের কমিউনিটিতে ইতিবাচক আচরণগত পরিবর্তনে জোরাল ভূমিকা রেখে চলেছে।”
কক্সবাজারে হাইজিন সচেতনতা কার্যক্রমে অবদান রাখার জন্য জাপান সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, দি ইউনাইটেড কিংডম’স ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি), দি ইউনাইটেড স্টেটস ব্যুরো অব পপুলেশন, রিফিউজিস, এন্ড মাইগ্রেশন (পিআরএম), এবং দি সুইডিস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সী (সিডা) )-এর প্রতি ইউনিসেফ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।