সামাজিক কেন্দ্রে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত এই উদ্যোগ কক্সবাজারে শরণার্থী এবং স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছে
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
চার বছর আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সোয়াইব যখন বাংলাদেশে আসে, তখন সে শরণার্থী শিবিরের বাইরে যেতে ভয় পেতো। আগের বছর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সহিংসতায় তখনও তার মধ্যে আতংক কাজ করতো। তবে, কক্সবাজারের স্বাগতিক কমিউনিটির কাছ থেকে কী আশা করা যায় তা সে তখনও জানতো না। শরণার্থীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের বিষয়টি সে শুনেছিল। কারণ, নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে বেশ বড় শরণার্থী জনসংখ্যার বিষয়ে কিছু লোক বেশ উদ্বিগ্ন ছিল।
১৪ বছর বয়সী ছেলেটির বেশিরভাগ দিন নিজের খুপরি ঘরের ভেতরে কাটিয়েছে। সে তার সাত ভাইবোনদের সাথে একটি ছোট ঘরে ভাগাভাগি করে থাকতো। তার বয়সী ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীর মতো, আশ্রয়শিবিরে তার শিক্ষার সুযোগ ছিল না। নতুন করে শিখতে শুরু করার বিষয়ে তার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
একজন সমাজসেবা কর্মী সোয়াইবকে সোশ্যাল হাব বা সামাজিক কেন্দ্র সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। এই সামাজিক কেন্দ্র রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরীদের জীবন দক্ষতা, খেলাধুলা কার্যক্রম এবং একটি লাইব্রেরির সুযোগ প্রদান করে। তারপর থেকে, এটি সোয়াইবের প্রিয় একটি জায়গা হয়ে উঠেছে। কারণ এটি তাকে মিয়ানমারে তার শ্রেণীকক্ষের কথা মনে করিয়ে দেয়।
গত দুই বছরে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ থিয়েটার আর্টস দ্বারা পরিচালিত ইউনিসেফ সমর্থিত এই সামাজিক কেন্দ্রে যুব নেতৃত্ব এবং পিয়ার-টু-পিয়ার বিভিন্ন কর্যক্রমে সোয়াইব অংশ নিয়েছে। একটি প্রাথমিক কম্পিউটার স্বাক্ষরতা কোর্স শেষ করার পর সে এখন নতুন প্রযুক্তি শিখতে আগ্রহী। সামাজিক কেন্দ্রের "সামাজিক পরিবর্তনের দূত" কর্মশালার মাধ্যমে সে যে দক্ষতা অর্জন করেছিল তার জন্য সে কৃতজ্ঞ। সোয়াইব এখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার সুযোগের পক্ষে কথা বলে।
অভিজ্ঞতা বিনিময়
সামাজিক কেন্দ্রের মাধ্যমে দু’জন বাংলাদেশি কিশোরের সাথে তার পরিচয় হয়। তাদের একজনের নাম জামাল যার বয়স ১৬ বছর এবং আর অন্যজন ১৫ বছর বয়সের আরিফুল। জামাল এবং আরিফুল সমবয়সী রোহিঙ্গা শিশুদের সাথে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ থেকেই যে এই কেন্দ্রে এসেছিল ঠিক তেমনটা নয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়শিবিরগুলো ঘুরে দেখতে পারবে কিনা সে বিষয়টি জামাল সোয়াইবকে জিজ্ঞেস করল। এরপর রোহিঙ্গা ছেলেটি যখন বাংলাদেশি কিশোরদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়, তখন তারা শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবনযাত্রা দেখে হতবাক হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে যে এদের শৈশব সংকীর্ণ গলিতে এবং স্যাঁতস্যাঁতে ও অন্ধকারাচ্ছন্ন তাঁবুতেই কেটে যাচ্ছে।
কিভাবে তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল সেই বিষয়ে গল্প করার সময় সোয়াইব হেসে বলে, “জামাল বলতো আমার জায়গাটা বেশ সুন্দর”। তার বাড়িটি যে খুব ছোট - বাংলাদেশি ছেলেটি স্বীকার করেছে যে, সে তার বন্ধুকে এটা বলে কষ্ট দিতে চায়নি।
ইদানীং তাদের বন্ধন আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তারা এখন সামাজিক কেন্দ্রের বর্ণিল কক্ষে বসে বা খেলা করে, একে অপরকে তাদের দেশ সম্পর্কে জানায় এবং তাদের কমিউনিটিকে প্রভাবিত করে এমন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। অনলাইন ভিডিও দেখে সোয়াইব কিছু ইংরেজি শিখেছে এবং এখন সে তার বন্ধুদের ইংরেজি শেখাচ্ছে। কারণ, সোয়াইব তার বন্ধুদের দ্বারা প্রাপ্ত সহযোগিতার জন্য তাদের প্রতিদান দিতে চায়।
জামাল সোয়াইবকে টেকনাফে তার বাসায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। যখন এই কিশোররা বাংলাদেশী গ্রামের মধ্য দিয়ে একসাথে হাঁটছিল, তখন তারা অনেক কৌতূহলী চোখ তাদেরকে লক্ষ্য করছিল। স্বাগতিক কমিউনিটির যুবকরা দুই বন্ধুকে একসাথে হাঁটতে দেখে এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল। কারণ অন্যদের কাছে এটি ছিল এক বিরল দৃশ্য।
উন্নত জীবনের দিকে যাত্রা
" দারুন তো! তুমি একজন রোহিঙ্গার সাথে বন্ধুত্ব করেছো। তার মত অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে আমরা কীভাবে দেখা করতে পারি?” সোয়াইবের সাথে দেখা করার সময় গ্রামবাসীদের উৎসাহী প্রতিক্রিয়া জামাল সোয়াইরের নিকট এভাবেই বর্ণনা করছিল। শরণার্থী শিবিরের সামাজিক কেন্দ্রে জামাল এখন বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীদের দলীয় ভিজিটের আয়োজন করে।
জীবন দক্ষতা অর্জন এবং সমমনা বন্ধুদের সাথে দেখা করার যে সুযোগ সামাজিক কেন্দ্রগুলো প্রদান করেছে তার জন্য সে খুবই কৃতজ্ঞ। ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি থেকে আসা সত্ত্বেও, রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পার্থক্যের চেয়ে মিল রয়েছে অনেক বেশি। তারা সবাই শেখার, উপার্জন করার এবং শান্তিতে বসবাসের অধিকার নিয়ে আলোচনা করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মসূচি দ্বারা সমর্থিত ইউনিসেফের এই কর্মসূচির লক্ষ্য হল শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপনে অবদান রাখা, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান বৃদ্ধি করা, সামাজিক সংহতি জোরদার করা এবং রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে দূরত্ব দূর করা।