বাংলাদেশে যেসব শিশু টিকার একটি ডোজও পায়নি তাদের কাছে পৌঁছাতে ভ্রাম্যমাণ সেবা
কৃষি পরিবার ও কারখানার কর্মীদেরকে তাদের শিশুদের টিকা দিতে সাহায্য করা

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
আবহাওয়া ভালো থাকলে প্রতিদিন সকালে স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দল বাংলাদেশের বান্দরবান অঞ্চলের থানচি ক্লিনিক থেকে যাত্রা করে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ওই দলটির লক্ষ্য হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের উঁচু এলাকায় প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে রক্ষা করতে তাদের কাছে পৌঁছানো।
ক্লিনিক থেকে খুব ভোরে এই যাত্রা শুরু হয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত রেফ্রিজারেটর থেকে সাবধানে ভ্যাকসিনের ডোজ বের করে তা বহনযোগ্য ঠান্ডা বাক্সে প্যাক করেন। সকাল ৭টার দিকে ভ্রাম্যমাণ দলটি সাঙ্গু নদীর তীরে একটি স্থানীয় ট্যাক্সিতে ওঠার জন্য প্রস্তুত।
অগভীর সাঙ্গুর মধ্য দিয়ে দুলতে দুলতে চলতে থাকা কাঠের নৌকায় তাদের যেতে এক ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। তবে এটি নির্ভর করে তারা কোথায় যাচ্ছে তার ওপর।
“সোজা হয়ে বসুন এবং হেলান দেবেন না,” পাথুরে এলাকাগুলো পার হওয়ার সময় চিৎকার করে বলেন নৌকার মাঝি। নৌকার মোটরের শব্দ ও ঢেউয়ের বাইরে তখন পাখির কল-কাকলি বেশি শোনা যায়।
প্রতিটি গ্রামে যাতে সেবা পৌঁছানো যায় সেজন্য দলটি ভাগ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যকর্মী উবাহিন পাহাড় বেয়ে মংলংপাড়া গ্রামে যাত্রা করেন।
“পার্বত্য অঞ্চল খুব কম জনবসতিপূর্ণ। তাই আমি আমার আওতাভুক্ত এলাকার প্রায় সবাইকে চিনি,”- বলেন উবাহিন। তার প্রথম গন্তব্য হলো সম্প্রদায়ের নেতার বাড়ি, যেখানে তিনি একটি টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং এটিকে একটি বেস হিসেবে ব্যবহার করেন। সেখান থেকে তিনি অন্য গ্রামেও যেতে পারেন।
ভৌগোলিক বাধা অতিক্রম করে টিকার একটি ডোজও পায়নি (জিরো-ডোজ) এমন শিশুদের কাছে পৌঁছানো
চার মাস বয়সী নাইয়ু টিকার একটি ডোজও পায়নি। এর মানে হলো সে যক্ষ্মা, হুপিং কাশি, পোলিও ও হামসহ নয়টি রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য প্রণীত ও সুপারিশকৃত চারটি টিকা পায়নি।
“আমার ছেলের জন্মের পর, আমি তাকে টিকা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে টিকা দেওয়া কোনো স্থান ছিল না। আমরা সম্প্রতি আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি এবং আমরা ফিরে আসার পর এটিই টিকাদান কার্যক্রমের প্রথম সেশন,”- বলেন নাইয়ুর মা।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ টিকাদান ও শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশে এখন এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ৮৪ শতাংশই জাতীয় টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে।
তবে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের মাঝে সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণের হার কম। এটি বিশেষ করে নাইয়ুর বাবা-মায়ের মতো বাবা-মায়েদের জন্য সত্য, যারা টিকা কেন্দ্রে যাওয়ার খরচ বহন করতে পারে না বা যারা তাদের সন্তানদের কর্মদিবসে টিকাদান কার্যক্রমে নিতে পারে না। আর এভাবে যখন বিচ্ছিন্নভাবে শিশুরা টিকার গ্রহণের থাকে, তখন রোগগুলো পুনরায় ফিরে আসতে পারে।
বাদ পড়া টিকার ডোজ শনাক্ত করার ব্যবস্থা
উবাহিনের সহকর্মী শাকি পাহাড়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করেন।
“আমরা রেকর্ড রাখি, তাই আমরা জানি কোন শিশুকে কোন দিনে কোন টিকা দিতে হবে। প্রতিটি টিকাদান কার্যক্রমের পরে আমি বইগুলো খুঁজে দেখি কে টিকা নিতে আসেনি। আমরা যদি ফোনে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি, তাহলে আমরা তাদের বাড়িতে যাই। শিশুর সবগুলো টিকা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই কাজ বারবার করি,”- বুঝিয়ে বলেন শাকি।
তিনি বলেন, “চাষাবাদ ও ফসল কাটার মৌসুমে, পরিবারগুলো পাহাড়ের আরও ওপরে তাদের খামারে থাকে। স্বাস্থ্য তাদের কাছে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, ওই সময়ে তাদের জন্য খামার ছেড়ে কোথাও যাওয়া কঠিন। এর ফলে শিশুরা টিকাদান কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ে যায়।"
এ কারণেই স্বাস্থ্য কর্মীদের বেশ কয়েকবার দীর্ঘ ভ্রমণ করতে হয়, প্রতিটি শিশুকে টিকা দেওয়ার জন্য একই এলাকায় বারবার যেতে হয়।
আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের ভার বহন করছে শিশুরা
শুধু গ্রামীণ এলাকার পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছানোই কঠিন হতে পারে, তা নয়। শহরে বাবা-মায়েদেরও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়, বিশেষ করে যারা দীর্ঘ সময় কারখানায় বা স্বল্প বেতনের কাজ করেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে টিকা থেকে বাদ পড়া শিশুদের সেবা দিচ্ছেন। তারা ভ্রাম্যমাণ টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করছেন এবং ক্লিনিকে যাওয়ার সময় নির্ধারণের ব্যবস্থা করছেন, যাতে শহরের দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্যও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ টিকা ও বৃহত্তর স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা যায়।
তিন সন্তানের মা ফাতেমা একজন গৃহকর্মী। তিনি বলেন, “আমি আমার শিশুদের খাবার জোগাড় করতে তিনটি বাসায় কাজ করি। আমার কোনো ছুটি নেই। আমি আমার সন্তানদের ভালো কিছুর জন্য সময় দিতে চাই, কিন্তু কাজে না গিয়ে আমার কোনো উপায় নেই।’’
থানচি গ্রামের বিপরীত চিত্র মোহাম্মদপুরে। এটি ঢাকা শহরের ঘনবসতিপূর্ণ একটি আবাসিক এলাকা, যেখানে সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। তা সত্ত্বেও ফাতেমার সবছোট সন্তান চার মাস বয়সী হাদিয়াতের টিকার একটি ডোজও (জিরো-ডোজ) হয়নি।
স্বাস্থ্যকর্মীরা ফাতেমার বাড়িতে গিয়ে তাকে না পাওয়া পর্যন্ত এবং সুবিধাজনক সময়ে সে যাতে ক্লিনিকে যায় সে ব্যবস্থা করার আগ পর্যন্ত তার বাড়িতে যেতেই থাকেন। ঘরে ঘরে সেবা পৌঁছে দেওয়ার কল্যাণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জিরো-ডোজ শিশুদের মতো হাদিয়াত এখন তার টিকার সর্বশেষ ডোজগুলো পেয়েছে।
বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন: বাংলাদেশে এখন জিরো-ডোজ বা টিকার একটি ডোজও পায়নি এমন এক বছরের কম বয়সী শিশু মোট সংখ্যার এক শতাংশেরও কম। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে এর অর্থ হলো– এখনও এক বছরের কম বয়সী ৩০ হাজার শিশু রয়েছে, যারা টিকার একটি ডোজও পায়নি।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের জন্য শৈশবকালীন সব টিকা ক্রয় ও সরবরাহ করে। ২০২২ সালে ইউনিসেফ ৮ কোটি মার্কিন ডলারের ১৭ কোটি ৩০ লাখ ডোজ শৈশবকালীন টিকা সরবরাহ করেছে। এই টিকাগুলো ক্রয়ে অর্থায়ন করেছে ‘ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, গ্যাভি’ ও বাংলাদেশ সরকার।