প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীরা তাদের স্বপ্নের পেছনে ছোটার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাকে বাধা হতে দেবে না
দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধার কল্যাণে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অন্তত কিছু সংখ্যক একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে।

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধার কল্যাণে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অন্তত কিছু সংখ্যক একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে।
বাংলাদেশের ভোলার নাঈম ১৪ বছর বয়সেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে। সে এখন হাঁসের খামারের গর্বিত মালিক। তার ৩০টির বেশি হাঁস রয়েছে। সে প্রতিদিন যত্ন সহকারে এদের লালন-পালন করে।
নাঈম পশু-পাখি অনেক ভালোবাসে। এই ব্যবসায় আবেগের কোনো স্থান নেই। তাই হাঁসগুলো যখন যথেষ্ট বড় হয় তখনই সেগুলো বিক্রি করার জন্য নাঈম বাজারে নিয়ে যায়। প্রতিটি হাঁস প্রায় ৫০০ টাকায় (প্রায় ৫.৮০ ডলার) বিক্রি হয়।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত একটি প্রকল্পের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবসাটি নাঈমের পরিবারের জন্য পরিমিত আয়ের ব্যবস্থা করেছে। এর মাধ্যমে নাঈম তার কাজের উদ্ধেশ্য খুঁজে পায় এবং স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। শৈশবকাল থেকেই নাঈম প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে জীবনযাপন করেছে, শৈশবকাল থেকেই এই প্রতিবন্ধীত্ব তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল করে দিয়েছে এবং স্মৃতিশক্তির উপরে প্রভাব ফেলেছে।
নাঈম জানায়, “সমস্যাটা আমার হাত-পায়ে। জামাকাপড় ধোয়া, বালতি বা হাঁড়িতে পানির মতো ভারী কিছু বহন করতে আমার অসুবিধা হয়।”

নাঈম আসলে একা নয়। ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে ১৭ বছরের কম বয়সী শিশুদের সাত শতাংশে এক বা একাধিক প্রতিবন্ধীত্ব রয়েছে। সামাজিক ট্যাবু এবং বৈষম্যের ফলে তাদের অনেকেই সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাদের সমবয়সীদের তুলনায়, প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে যাওয়ার, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বা কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা প্রশিক্ষণ থেকে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ব্যবসা শুরু করা বা বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনের জন্য নাঈমের মতো কিশোর-কিশোরীদের ১৮ মাসের মধ্যে নগদ ৩৬,০০০ টাকা (প্রায় ৪১৮ ডলার) প্রদান করা হয় যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে সহায়তা করে। এই কর্মসূচির আওতায় কাউন্সেলিং এবং চিকিৎসা সেবাও প্রদান করা হয়।
প্রতিবন্ধীকতা স্বপ্নের পথে বাধা হয় না
ওমরের সব সময়ের পছন্দের বিষয় ছিল ফ্যাশন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে একজন দর্জি হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে ওমর । প্রকল্পটির আওতায় ওমরকে সেলাই দক্ষতার প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম প্রদান করা হয়েছিল।

১৫ বছর বয়সী ওমরের গ্রাহকের সংখ্যা এখন অনেক। তার সেলাই মেশিন নিয়ে যখন সে তার কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে তখন সে নিজেকে সবচেয়ে সুখী বলেই মনে করে।
জামার গলা এবং হাতার ডিজাইন বর্ণনা করার সময় ওমর জানায়, “ডিজাইনের দক্ষতা অর্জন করে আমি বড় কিছু করতে চাই। এখন খুব সুন্দর সুন্দর ডিজাইন আছে।” সে আরও জানায়, “আমি আসলে এধরণের কাজ পছন্দ করি। সেকারণেই আমি সেলাইয়ের কাজ শিখতে চেয়েছিলাম।”
ওমর যখন ছোট ছিল, তখন সে একটি দুর্ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হয়েছিল। চিকিৎসকরা তখন তার হাত এবং বাহু রক্ষা করতে পারেননি। সংক্রমণের পরে এগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল। অস্ত্রোপচার করার পর সুস্থ হয়ে তিন মাস সে হাসপাতালে কাটিয়েছে।
স্মৃতি চারণ করে সে জানায়, “প্রথমদিকে এটি খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। তখন আমি কোনো কাজ করতে পারতাম না। কিন্তু আমি সব সময় চেষ্টা করে গেছি।”
এই সংকল্প ওমরকে আজও চালিত করে। তার দৈনন্দিন কাজগুলো সে নিজেই করে এবং এর জন্য কারও সহযোগিতা প্রয়োজন হয় না। ঠিক অন্য কিশোরদের মতো সেও তার বন্ধুদের সাথে ফুটবল এবং ব্যাডমিন্টন খেলতে ভালোবাসে।
ট্যাবু এবং বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ
নূপুর আর একটি কিশোরী, এই প্রকল্পের মাধ্যমে যার দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে। নগদ ফেরত দেয়ার শর্তসাপেক্ষে ১৭ বছর বয়সী নূপুর কম্পিউটার দক্ষতা প্রশিক্ষণকে বেছে নিয়েছে। নূপুর স্বপ্ন দেখে সে একটি অফিসে কাজ করবে, গ্রাফিক ডিজাইন, ফটোশপ এবং এক্সেল দক্ষতাগুলোকে ভালভাবে কাজে লাগাবে।

নূপুর ভোলার চরফ্যাসনের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
নূপুর বিশ্বাস করে যে সব মানুষ শুধু তার প্রতিবন্ধিকতাকে দেখে এবং সে কি করতে পারে তা দেখে না - এই ধরনের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সেসব মানুষের কাছ থেকেও এখন সে সম্মান পাবে। নূপুর আরও জানায়, “এই দক্ষতা অর্জন করে আমার এখন খুব ভাল লাগছে এবং এই দক্ষতা ব্যবহার করে আমি ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবো।”
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নূপুর রাস্তা দিয়ে চলার সময় তার প্রতিবন্ধীকাতা সম্পর্কে বিশেষ করে মেয়েদের এবং অপরিচিতদের কাছ থেকে অনেক খারাপ মন্তব্য শুনেছে। নূপুর জানায়, “অনেক নারীই তাকে বলেছে যে, সে প্রতিবন্ধী, দেখতে সুন্দর নয়, তার বিয়ে কীভাবে হবে, বা নিজের জীবন ধারণের জন্য সে কী করবে?” সে আরও জানায়, “আমি এসব নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন হই না। আমি যদি কিছু করতে পারি কিংবা আমি যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, তাহলে তারা এমনিতেই আমাকে পছন্দ করবে- আমি এমনটাই বিশ্বাস করি”।
ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলি বলেন, “বিশ্বের প্রতিটি শিশুর মতো, প্রতিবন্ধী শিশুদেরও তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করার জন্য লালনপালন, সমর্থন এবং উৎসাহ পাবার অধিকার রয়েছে। তাদের দক্ষতার বিকাশ ঘটানো এবং তাদের জন্য বিনিয়োগ করা দরকার যাতে তারা তাদের নিজস্ব উপার্জন করতে পারে। এতে করে বর্জন ও বিচ্ছিন্নতার জীবন এবং অংশগ্রহণ ও সংযোগের জীবনের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হতে পারে।”
শিশু সুরক্ষা কর্মসূচিতে অবদানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের তাদের অধিকার সম্পর্কিত দাবি আদায়েরজন্য ক্ষমতায়িত করা।