জীবনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে সৃজনশীল অনুপ্রেরণার সন্ধান
‘নিরুৎসাহিত করা না হলে শিশুরা যে কোনো কিছুই করতে পারে,’ কথাটি বলেছে তিনবারের মিনা মিডিয়া পুরস্কার বিজয়ী শিশু ব্যক্তিত্ব

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
অনেক বছর আগে চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহ আছে এমন ব্যক্তিদের আলোচনায় একজন বক্তা শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন যে, শিশুরা যদি ইচ্ছা করতো তবে তারা চলচ্চিত্র বানাতে পারতো। সেসময়ে ৭ম গ্রেড সম্পন্নকারি সৈয়দা আবরার তোহা দ্রাহা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারেই কথাগুলোকে গ্রহণ করেছিল এবং ঘটনার পরপরই তার মায়ের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছিল।
গত কয়েক মাস ধরেই সে শিশু চলচ্চিত্র সোসাইটি বাংলাদেশের সদস্য হয়েছে এবং স্ক্রিপ্ট লেখা, গল্পবলা এবং ষ্টোরিবোর্ডের উপর অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নিয়েছে। তার প্রথম প্রকল্পটি সম্পন্ন করার পরে সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রকল্পটি সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাবার কারনে চলচ্চিত্র তৈরির বিষয়ে আরো উৎসাহী হয়ে ওঠে সে। এরপর তিন বছরের মধ্যে ১৬ বছর বয়সী দ্রাহা তার চলচ্চিত্রের জন্য অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে। এছাড়াও দ্রাহা তার স্টপ-মোশান অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘রাইজ’ এর জন্য মর্যাদাপূর্ণ মিনা মিডিয়া পুরস্কারের সৃজনশীল ভিসুয়াল বিভাগে প্রথম পুরস্কার জিতেছে।
বড়বোন সৈয়দা আশফা তোহা দূতিকে সঙ্গে নিয়ে সে এই চলচ্চিত্র বানিয়েছিল। ২০ নভেম্বর মিনা মিডিয়া পুরস্কারের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রথম পুরস্কার পাওয়া এই দুই বোনই ছিল অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ এবং অনুষ্ঠানের দিনটি ছিল বিশ্ব শিশু দিবস।
"আমার তৈরি করা একটি মাটির পুতুল ছিল এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র। স্টপ-মোশানের আড়াই মিনিটের মধ্যে আমি দেখাতে চেয়েছিলাম কীভাবে প্রতিটি ধাপে একজন নারীকে বাধার সন্মুখিন হতে হয় এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য কীভাবে বাধাগুলোকে অতিক্রম করতে হয়”, রাজধানীর প্যান-প্যাসিফিক সোনারগাও হোটেলে অনুষ্ঠানশেষে সে কথাগুলো বলেছিল।
স্টপ-মোশান অ্যানিমেশন কী?
দ্রাহা বলেছিলো, “এটা একটি কৌশল এবং আমি এতে বেশ আগ্রহ পাই”।
পৃথক পৃথকভাবে তৈরি ছবির ফ্রেমগুলোর মধ্যে বস্তুকে শারীরিকভাবে কীভাবে একটু একটু করে সরানো যায় সেটা ইন্টারনেট অনুসন্ধান করার মাধ্যমে সে শিখেছিলো যাতে করে যখন ফ্রেমগুলো একসঙ্গে রেখে খেলানো হয় তখন সেগুলোর অ্যানিমেশন প্রদর্শিত হয়।
"একটি ক্যামেরার সামনে আমরা মাটির বস্তুটিকে রাখি এবং যেহেতু আমরা সেটির ছবি তুলছি; সে কারনে বস্তুটিকে খুবই সামান্য সরিয়ে দিই। আড়াই মিনিটের এই অ্যানিমেশানটি তৈরি করতে আমাদের দেড় হাজারেরও বেশি ছবি তুলতে হয়েছিলো। দূতি ছবিগুলো তুলেছিলো এবং আমি পরে সেগুলো সম্পাদনা করে চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলাম”।
সৃজনশীল অনুপ্রেরণার উৎস
"'রাইজ’-এর মাটির পুতুলের মতো আমার মা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমখি হতেন এবং প্রতিদিন কীভাবে এগুলোকে অতিক্রম করতেন সেগুলো দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম”।
তার মা দয়াগঞ্জের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা আজিজুন নাহার। “যতক্ষণ না আমি আমার পড়াশোনায় অমনোযোগী হতাম” ততক্ষণ পর্যন্ত তার এসব করজক্রম নিয়ে কখনো কিছু মনে করতেন না তিনি।
“অতীতে আমি শিশু নির্যাতন নিয়ে এরকম দুটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছি”।

পিতামাতার সতর্ক উৎসাহ
তারা মনে করতেন যে, অতিমাত্রায় পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কাজে জড়িত থাকলে পড়াশোনা ব্যাহত হতে পারে। “যখন আমি আমার মা-বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা বললাম, তখন তারা আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন, কিন্তু একইসাথে প্রথমতঃ আমি যেন আমার পড়াশোনার প্রতি খেয়াল রাখি সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন”।
“তাদেরকে কখনোই আমার সম্পর্কে বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়নি। ইদানিং যখন আমার মা কোনো চলচ্চিত্র উৎসব বা প্রতিযোগিতার বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন তখনই আমাকে এসব বিষয়ে জানান”।
সে তার এই আনন্দের খবর প্রথমেই বিদ্যালয়ের বন্ধুদের বলতো না। যখন সে পুরস্কার পেতো, তারপরই তার শ্রেণিকক্ষের সবাই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারতো।
“অনেকেই বলতো যে, তাদের মা-বাবা পড়াশোনার বাইরে কোনো সময় তাদেরকে ব্যয় করতে দিতো না। তারা সবসময়ই আমাকে বলতো যে, আমি আমার মা-বাবার অনুপ্রেরণার কারনেই এসব করতে পারছি”।
পুরস্কার জেতার ধারাবাহিকতা
“আমি প্রথম ২০১৬ সালে ‘দ্যা রেজাল্ট’-এর জন্য পুরস্কার পাই। এটি ছিল রানার-আপ পুরস্কার। ২০১৭ সালে ‘দ্যা রাইজ’- এর জন্য প্রথম পুরস্কার পাই যা ছিল আমাদের সমাজের কুসংস্কারকে দুর করার ক্ষেত্রে আমার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ”।
সে আরো বলে যে, “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের উপর অনেক কাজ ও সময়সীমার বোঁঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া এ কাজ শেষ করার জন্য সব সময় চাপের মধ্যে থাকে তারা। পরীক্ষায় তাদেরকে অবশ্যই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই এরূপ ঘটে থাকে”।
সে বিশ্বাস করে যে, যদি তাদের চেষ্টা থাকে এবং তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা না হয়, তবে যে কোনো মেয়ে নতুন যে কোনো কিছুই করতে পারে।
তার বাবা সংবাদপত্রে প্রকাশিত মিনা পুরস্কারের বিষয়টি প্রথম দেখেছিলেন এবং তাকে বিষয়টি জানিয়েছিল।
“তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে আমার আগ্রহের বিষয়টি জানতেন এবং আমি এই পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে আগ্রহী কিনা সেটা একদিন সকালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন এটি আমি ভালোভাবে দেখলাম এবং ইউনিসেফ-এর সাথে যোগাযোগ করলাম। আর এভাবেই আমি শুরু করেছিলাম”।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সে আরো বলে যে, “আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে পড়তে চাই। আজকাল প্রায় সকলেই বানিজ্যিক সিনেমা তৈরি করছে। আমি কিন্তু কিছু বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চাই। আমি আমার চলচ্চিত্রকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শন করতে চাই”।