চিত্রাংকন যখন শিশু সুরক্ষার হাতিয়ার
বাংলাদেশে চিত্রাংকন শিশুদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসছে, পরিচিত করছে জরুরি সেবাসমূহের সঙ্গে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
ঢাকার কড়াইল বস্তির কাদামাটির সরু গলিপথ ধরে এগিয়ে গিয়ে ছোট একটি ঘরে দেখা যায় ৪০টি শিশুকে। টিনের বেড়ার ওই ঘরের ভেতরে উচ্ছ্বাস ও আনন্দমুখর পরিবেশ। যা বাইরের মন খারাপ করা পরিবেশকে ভুলিয়ে দেয়।
নয় বছর বয়সী মীম ও তার বন্ধুরা সেখানে একের পর এক ছবি দেখছিল। সেসব ছবি দেখানো হচ্ছিল প্রজেক্টরে। নৌকায় জেলে, নারীদের পানি নিয়ে যাওয়া, গাছে পাখি, একজন প্রবীণ ব্যক্তির ঢাক বাজানো, গ্রামের মাঠে শিশুরা খেলছে- বাংলাদেশের এমন সব চিত্র সেখানে দেখানো হচ্ছিল।
ব্রাজিলিয়ান চিত্রশিল্পী লিন্ডা ভেলেন্তে দা সিলভা আকুরি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবিগুলো দেখাচ্ছিলেন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে শিশুদের সম্পৃক্ত করার ওপর রয়েছে তাঁর বিশেষ দক্ষতা। ছবি পছন্দ হলে শিশুরা ‘হ্যাঁ’ বলে চিৎকার করে উঠে আর পছন্দ না হলে সমস্বরে ‘না’ বলে ওঠে। শেষ পর্যন্ত গাছে একটি পাখির ছবির পক্ষে বেশির ভাগ শিশুর রায় আসে। লিন্ডা তাদেরকে ওই পাখি ও গাছের অবয়ব আঁকতে বলেন। পরে তাতে রং করতে বলেন।
মীম প্রথমে এগিয়ে আসে। সে ছবি আঁকতে ভালোবাসে। আজ নিজের এলাকায় ইউনিসেফের সহযোগিতায় সরকার পরিচালিত শিশুদের নিরাপদ কেন্দ্রে (কমিউনিটি হাব) বিশেষ এই সেশন তার খুব ভালো লাগে। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মীম বলে, ‘আমি বাড়িতে ঘর ও নৌকা আঁকি। আজ আমরা এখানে অনেক বড় ছবি আঁকছি। আমার মনে হচ্ছে, এটা খুব সুন্দর হবে।’
ইউনিসেফ সারা দেশে এমন ১৪০০ কমিউনিটি হাবে সহায়তা দেয়। এটা করা হয় যাতে শিশু ও তাদের পরিবার একটি নিরাপদ জায়গা পায়, যেখানে তারা সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং শিশুশ্রম নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ কীভাবে পাওয়া যায়- সে সব বিষয়ে জানতে পারে এবং এগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়।
অপ্রচলিত কিন্তু কার্যকর টুল
ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে কমিউনিটি হাবে শিশুদের চিত্রাংকন চালু করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো, কমিউনিটি হাবের প্রতি শিশুকে আকৃষ্ট করা, সামাজিক সেবাসমূহে আরও বেশি শিশুর অন্তর্ভুক্তি এবং এখানে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশে চিত্রশিল্পীর সঙ্গে কাজের মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে অংশীদারত্বের বোধ তৈরি করা ।
"প্রতিটি পেইন্টিং সেশনের আগে, শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা সমন্বয়কারীরা (VACW সমন্বয়কারী) সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয়ে শিশুদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে এবং প্রয়োজনে তাদের সেবাগুলোতে রেফার করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন," বললেন এলিসা ক্যাল্পোনা, চাইল্ড প্রটেকশন ম্যানেজার, যিনি ক্ষতিকারক অভ্যাস প্রতিরোধে কাজ করেন।
চিত্রশিল্পী লিন্ডা ২০১০ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাজ, আমার নিবেদন হচ্ছে, এই ঘরের উজ্জ্বল আলোর মতো শিশুদের প্রস্ফুটিত হতে সহায়তা করা। প্রতিটি রং তাদের কেমন অনুভূতি দেয়, তা আমি তাদের কাছে জানতে চাই। হলুদ রং দিয়ে খুশি বোঝায়, নীল বোঝায় শান্ত থাকা, কালো দুঃখের প্রতীক আর লাল হলো ক্ষোভ বা ক্রোধের প্রতীক।’
যে দেশে সাড়ে চার কোটি শিশু নিজের বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়, ৬৮ লাখ শিশু শ্রমে যুক্ত এবং অর্ধেক কন্যাশিশুর ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়, সে দেশে শিশু সুরক্ষার সেবাসমূহের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
এ বিষয়ে ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রটেকশন সেকশনের প্রধান নাতালি ম্যাককয় বলেন, ‘কখনো কখনো এই প্রয়োজনীয়তা এতটাই স্পষ্ট যে, এর মধ্য দিয়ে অল্প বয়সী মায়েরা নির্যাতনের শিকার হলে সহায়তা পাওয়ার জন্য কোথায় যাবেন, তা জানতে পারেন আবার বাবা-মা শিশুদের পুনরায় স্কুলে ভর্তি করার বিষয়ে তথ্যও জানতে পারেন। এসব জরুরি সহায়তা ও তথ্য শিশু অধিকার লংঘন রোধ করতে এবং শিশুদের জীবনকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করে ।’
শিশু সুরক্ষার সমাধান
লিন্ডা এবং VACW কোঅর্ডিনেটররা ৭০ জন স্থানীয় চিত্রশিল্পীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন - কীভাবে তিনি শিশুদেরকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং চিত্রাঙ্কনে শিশুদের অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন, তা তিনি তাঁদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। লিন্ডা এবং স্থানীয় চিত্রশিল্পীরা মিলে একসাথে বর্তমানে সারা বাংলাদেশে ৭০০ কমিউনিটি হাবে প্রায় ৫০ হাজার শিশুকে ছবি আকার সাথে যুক্ত করেছেন। এসব কমিউনিটি হাবে প্রধানত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সেবা দেওয়া হয়ে থাকে।
কড়াইল বস্তির শিশুরা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এবং শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকার পাশের বাসিন্দা হলেও তাদের নগরজীবনের সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। দারিদ্র্য ও ঘনবসতিই তাদের বঞ্চনার জীবনের কথা বলে দেয়। এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা রিকশাচালক, গৃহকর্মী, দোকানকর্মী ও পোশাক শ্রমিকের মতো স্বল্প আয়ের কাজ করেন।
রংয়ের খেলায় আলোকিত দিন
ধীরে ধীরে চিত্রকর্মগুলো রূপ পেতে থাকে এবং যখন সেগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা দেখে খুদে শিল্পীদের চোখমুখ খুশিতে ভরে ওঠে। পুরো সময়ে লিন্ডা শিশুদের নির্দেশনা দিতে থাকেন।কোনো একটি শিশুর পছন্দের জায়গায় তার কোনো বন্ধু যদি ছবি আঁকতে থাকে তাহলে সেটি শেষ হয়ে তার পালা আসা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি ছবি আঁকার রং, তুলি ও রং করার বিষয়গুলোকে শিশুদের মিলেমিশে ব্যবহার করা শেখানোর মাধ্যমে তাদের ভাগাভাগি করে নেয়ার ও নিজের জিনিসগুলোর যত্ন নেবার শিক্ষা দেন।
আজকের এই চিত্রাংকন পর্ব অনুজ্বল ঘরটিকে মীমের মতো আরও শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলছে। এভাবে যত শিশু এখানে আসবে তত বেশি শিশুর সামাজিক সেবা প্রদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ এবং নিজেদের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা পা্ওয়ার সুযোগ বাড়বে।