“আমার মুরগির শেড ভরে গেছে”: কক্সবাজারে মায়েরা একাই যেভাবে দারিদ্র্যের চক্র ভাঙছে
ইউনিসেফের একটি অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি শিশুদের তাদের পরিবারের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত করতে সহায়তা করছে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
“আমি সারাক্ষণ শুধু ওকে নিয়েই ভাবতাম। অন্য কোন কিছুতেই আমার মন বসত না ,” নিজের ছয় বছর বয়সী সন্তানকে এতিমখানায় রেখে আসার কথা স্মরণ করে বলেন মিনুয়ারা। এ সময় তার গলা ধরে আসে।
মিনুয়ারা একাই তার মেয়ে আখিমনিকে বড় করছেন। তার স্বামী একজন জেলে। মিনুয়ারা যখন এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন তার স্বামী সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।
"আমি গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করে মাসে ৪ হাজার টাকা (৪০ মার্কিন ডলার) আয় করি। কিন্তু আমার মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ও আমাদের খাবারের জোগান দিতে এই টাকা যথেষ্ট ছিল না,"- মিনুয়ারা জানান।
ইসলামিক ধর্মীয় বিদ্যালয় সংযুক্ত একটি এতিমখানা। সেখানে দিনে তিন বেলা খাবার, থাকা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। নিজের মেয়েকে সেখানে পাঠানো ছিল মিনুয়ারার নেওয়া সবচেয়ে কষ্টের সিদ্ধান্ত।

এতিমখানায় যাওয়ার পর প্রথম তিন মাস আখিমনির কান্নাই থামছিল না। এদিকে শোকে-কাতর মিনুয়ারা তার ছোট্ট মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতে পারতেন না। সাপ্তাহিক পরিদর্শনের সময়, তিনি এতিমখানার গেইটের (প্রবেশদ্বার) আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন এবং দূর থেকে মেয়েকে দেখতেন। এই এতিমখানায় যাওয়ার গাড়ি ভাড়া জোগাড় করার জন্যও না খেয়ে সেই টাকা জমাতেন মিনুয়ারা।
পরিবারের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত হওয়া
চার বছর হয়ে গেল মিনুয়ারা তার সন্তানকে ছাড়াই থাকছেন। তিনি এখনও কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এলাকায় একটি ছোট ঘরে থাকেন। তার সেই ঘরের বেড়া বানানো হয়েছে প্লাস্টিকের শিট দিয়ে। তবে তার কুঁড়েঘরের পাশেই একটি নতুন বাঁশের কাঠামো রয়েছে। এটা তার নিজের দোকান।
২০২২ সালের মার্চ মাসে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ইউনিসেফের একটি প্রকল্পে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন। প্রকল্পটির মাধ্যমে ২ হাজার দরিদ্র পরিবারকে ছোটখাট ব্যবসা থেকে উপার্জন এবং সেইসাথে তাদের পুষ্টি ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য সহায়তা করা হয়।
কক্সবাজারে অপুষ্টির বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য এখনও একটি উদ্বেগের বিষয়। সেখানে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ২৫ জনের উচ্চতা তাদের বয়স অনুপাতে কম এবং প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১০ জন তাদের উচ্চতার অনুপাতে বেশি শীর্ণকায়। এরকারন, প্রয়োজনীয় ক্যালোরি ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য পরিমাণমত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার জোগাড় করতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে।

মিনুয়ারা বলেন, “আমি শিখেছি কীভাবে মুরগির জন্য খাবার তৈরি করতে হয়, রোগ থেকে কীভাবে তাদের রক্ষা করতে হয় এবং ডিম থেকে ছানা বের হতে কীভাবে সাহায্য করতে হয়। আমি একটি মুরগির শেড এবং ১০টি সোনালী মুরগি পাই। স্থানীয় জাতের চারটি মুরগিও কিনি। এগুলোর চাহিদা অনেক বেশি এবং আমি সেগুলো প্রতি কেজি ৪৮০ (৪.৫ মার্কিন ডলার) টাকায় বিক্রি করতে পারি।”
মিনুয়ারা তার ছোট খামারে মুরগি বিক্রি শুরু করার আগে মুরগীর সংখ্যা ২৬-এ উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছেন। তবে তিনি ইতোমধ্যে মুরগীর ডিম বিক্রি করছেন। ইউনিসেফ থেকে সহায়তা হিসেবে পাওয়া নগদ অর্থ দিয়ে তিনি তার কমিউনিটিতে একটি ছোট দোকান খোলেন। ডিম ছাড়াও তিনি এখন শিশুদের কাছে জনপ্রিয় স্ন্যাকস, যেমন- মুড়ি, ঝালমুড়ি ও চানাচুর, বিক্রি করেন।
তবে তার সবচেয়ে বড় আনন্দ মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারা। আয়ের নতুন উৎসের মাধ্যমে মিনুয়ারা এখন সহজে তার পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারেন।
“আমি যখন আখিমনিকে বাড়িতে আনার কথা জানাই, তখন সে খুব খুশি হয় এবং সে শুধু কাঁদতেই থাকে। তবে এবার ছিল আনন্দের অশ্রু। যখন আমি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি, তখন সে বেশ রোগা এবং স্ক্যাবিস নামক চর্মরোগেআক্রান্ত ছিল-” সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন মিনুয়ারা।

আমি আমার মায়ের জন্য খুব গর্বিত। মা একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছে। আমি তাকে আমাদের মুরগি দেখাশোনায় সাহায্য করতে পছন্দ করি।
শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পারা ছিল আখিমনির জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। তার মতো একই আনন্দ পেয়েছে ১৫ বছর বয়সী তানিয়া। তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে না পেরে তাকে এতিমখানায় পাঠিয়েছিলেন তার মা। তানিয়াও এতিমখানা থেকে বাড়ি ফিরেছে।

প্রতিটি শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাবার
তানিয়ার মা মনজুরা বেগমের জন্য এ নিয়ে কথা বলাটা খুবই বেদনাদায়ক। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কীভাবে মানুষের জীবনকে ধ্বংস করতে পারে তার আরেকটি উদাহরণ তিনি।
“ভালো পরিবর্তনগুলোর কথা বলি, আমি আগে ঈদের সময়েও একটি ডিম কিনতে পারতাম না। আর ইউনিসেফের সহায়তার কারণে এখন আমার ঘরে/কাছে ২২টি ডিম আছে"-বলেন মনজুরা। তিনি এসময় ডিম ভর্তি একটি ঝুড়ি দেখান এবং তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
চার সন্তানের জননী মনজুরা তার দুই মেয়েকে একটি এতিমখানায় পাঠিয়েছিলেন। কারণ তিনি তাদের লেখাপড়া ও খাবারের খরচ জোগাড় করতে পারতেন না। দৈনিক ১৫০ টাকা (১.৪৫ মার্কিন ডলার) মজুরির জন্য তাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মরিচ ক্ষেতে কাজ করতে যেতে হতো। এখন ইউনিসেফের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও দশটি মুরগির বাচ্চা পাওয়ার পর তিনি মুরগি পালন ও ডিম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
হাঁস-মুরগি পালন নারীপ্রধান একটি ছোট্ট পরিবারে আয়ের সহজ পথ তৈরির উপায়। এটি দরিদ্র পরিবারের নারী, শিশু ও কিশোরীদের জন্য পুষ্টিকর, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সাশ্রয়ী মূল্যের খাবারের জোগান দিতে সাহায্য করে।
"আমি আরও অর্থ উপার্জনের জন্য আরও বেশি ডিম বিক্রি করতে পারতাম। তবে আমার সন্তানেরা ডিম খেতে পছন্দ করে এবং এটি প্রোটিনের একটি ভালো উrস। আমি অবশেষে তাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে পারি। তানিয়া প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করছে যে সে ‘কালো’ নামের মুরগিটি খেতে পারবে কি না। কিন্তু আমি সবসময় বলি, ‘এমন কিছু করা যাবে না। ওরা আমার সন্তানের মতো"- বলেন মনজুরা।
মনজুরা ও মিনুয়ারার যে কেবল মুরগির ঘরগুলোই ভরে উঠেছে তা নয়, তাদের মনও ভরে উঠেছে আনন্দে - আপনজনকে কাছে ফিরে পাবার আনন্দ।