ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা + কোভিড-১৯ = বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীদের জন্য অশান্তি
বয়ঃসন্ধিকাল, মাসিক স্বাস্থ্য এবং দুশ্চিন্তা সম্পর্কিত সংবেদনশীল প্রশ্নের উত্তরের জন্য কিশোর-কিশোরীরা প্রশিক্ষিত সহকর্মীদের কাছে যায়
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
শারমিন আক্তার ইতি বয়ঃসন্ধিকালে নিজের মধ্যে যেসব পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন সে সম্পর্কে তার অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য কিশোর-কিশোরীর মতোই, ইতি তার মাকে সেসব বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে খুব বিব্রত বোধ করত।
এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পায়া যাবে এমন একটি কেন্দ্রের খবর পেয়ে ইতি সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে যাবার। ইতি তার নিজের সাহস সঞ্চয়ের জন্য তার একজন বন্ধুকে সাথে নেয়।
স্থানীয় কিশোর-কিশোরীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা (এএফএইচএস) কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা শারমিনের জন্য এতটাই সহায়ক ছিল যে, সে নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করতো।
১৮ বছর বয়সী শারমিন এখন তার সম্প্রদায়ের অন্যান্য মেয়ের সাথে মাসিক স্বাস্থ্য এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। এর মাধ্যমে চারপাশে থাকা সামাজিক ট্যাবু কমে যাবে এবং তার সহকর্মীদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাবে বলে সে আশা করছে৷ কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কেও ইতি তথ্য সরবরাহ করছে।
কোভিড-১৯-এর কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রায়ই খোলা জায়গায় বা ছাদে এসব সেশন পরিচালনা করা হয়। মন-মেজাজের পরিবর্তনের, বা ১৮ বছরের আগে মেয়েরা বিয়ে এবং সন্তান ধারণ করলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়, বা পিরিয়ড শুরুর "স্বাভাবিক" বয়স, এ সব বিষয়েই সেশনগুলোতে আলোচনা হয়।
শারমিন জানায়, “আমাদের সামাজিক কাঠামোর কারণে, বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা এত সহজ নয়”। শারমিন আরও জানায়, “এসব সেশনে আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি এবং আমাদের কথার গুরুত্বও দেয়া হয়। এছাড়াও আমাদের মধ্যে যেসব প্রশ্ন রয়েছে সে বিয়য়েও সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারি।”
কমিউনিটিভিত্তিক এসব সেশনে একটি বিয়য় নিয়ে আলোচনা করা হয়, তা হলো কিশোর-কিশোরীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা। সারা বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত একটি বিস্তৃত কর্মসূচি হলো এটি।
অস্থিরতা এবং বিশাল পরিবর্তনের একটি সময়
বাংলাদেশে ৩২ লক্ষ কিশোর-কিশোরী রয়েছে, যারা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। একটি বিশাল, এবং প্রায়শই বিভ্রান্তিকর, পরিবর্তনের সময়কাল হিসাবেই বয়ঃসন্ধিকালকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অনেক কিশোর-কিশোরী শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সমন্বিত হরমোনের বৃদ্ধির সাথে লড়াই করছে। এটি তাদের মধ্যে স্বাধীন স্বত্ত্বার বিকাশ ঘটাচ্ছে এবং শৈশবকে পেছনে রেখে যাওয়ার পাশাপাশি তারা তাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করছে।
এই অস্থির সময়টি বাংলাদেশের শিশুদের জন্য কোভিড-১৯ মহামারীর সাথে মিলে গেছে যা তাদের জীবন, শিক্ষা এবং বন্ধুত্বকে ব্যাহত করে চলেছে। এসব বিষয় তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম জানান, “তরুণ সম্প্রদায়ের উন্নতি নিশ্চিত করতে মানসিক স্বাস্থ্যসহ কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের সকল দিকে আমাদের বিনিয়োগ করা অত্যাবশ্যক৷ দুর্ভাগ্যবশত, বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের মতো বিষয়গুলোর সাথে এখনও অনেক ধরনের সামাজিক ট্যাবুর বিষয় যুক্ত রয়েছে। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করার মাধ্যমে এবং যে বিষয়গুলো তাদেরকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দেয় সেগুলো সম্পর্কে আরও ভালভাবে প্রচার করার মাধ্যমে আমরা এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারি।”
যেসব কিশোর-কিশোরী নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করছে এএফএইচএস কর্মসূচির মাধ্যমে তারা অনলাইন এবং টেলিফোন কাউন্সেলিং পেতে পারে।
মহামারী চলাকালীন কিশোর-কিশোরীদের, বিশেষ করে মেয়েদের, নিজেদের বাড়িতে সহিংসতার এবং নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যায় বেশ বৃদ্ধির বিষয়টি কাউন্সেলিং হেল্পলাইন পরিচালনায় সহায়তাকারী শামীমা আক্তার লক্ষ্য করেছেন। তিনি আরও বলেন, “হয় তারা নির্যাতিত হচ্ছেন, অথবা তারা সংক্রমিত হওয়ার ভয় এবং এর মাধ্যমে তাদের পরিবারের সদস্যদের হারানোর ভয় পাচ্ছেন।”
কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য মোকাবেলায় বাবা-মা এবং শিক্ষকদের গুরুত্ব স্বীকার করে, এএফএইচএস কর্মসূচি শিশুদের সুস্থতার উপর কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে তাদের জন্য অনলাইন সেশনের ব্যবস্থা করে। যখন শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হয়, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রিয়জন অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বিধিনিষেধের ফলে তারা তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের দেখতে বাধা দেয় - এসব বিষয়ে শিশুরা বিষণ্ণ বোধ করতে পারে যা অনেক অভিভাবক বুঝতে পারেন না।
শামীমা জানায়, “বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরী বলে যে, এরূপ পরিস্থিতিতে তারা খুব একাকী এবং অসহায় বোধ করে। কীভাবে তাদের সন্তানদের এই প্রাদুর্ভাবের দ্বারা সৃষ্ট মানসিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন, অনলাইন সেশনের মাধ্যমে আমাদের পিতামাতারা সে বিষয়ে শেখে। তাদের বাবা-মা তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত নয় বলে মনে হয়। তারা তাদের সন্তানদের এই প্রাদুর্ভাবের দ্বারা সৃষ্ট মানসিক চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন সে বিষয়ে অনলাইন সেশনের মাধ্যমে আমাদের অভিভাবকরা শিখেছেন।”
যোগাযোগ রাখা এবং সক্রিয় থাকা
মহামারী চলাকালীনও তারা সহযোগিতা পেতে পারে, এমনটি জেনে অনেক কিশোর-কিশোরীর পক্ষে তাদের উদ্বেগ, ভয় এবং চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে।
১৬ বছর বয়সী ঝর্ণা আক্তারের মনে পড়ে, একদিন এএফএইচএস কেন্দ্র থেকে ফোন করে সে ঠিক আছে কিনা সে বিষয়ে বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছিল।
একজন বিশ্বস্ত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার পর সে এখন একাকী বোধ করে না এবং ভীতও নয়।
ঝর্না জানায়, “তারা আমাকে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত তথ্য দিয়েছে, কীভাবে নিরাপদ থাকতে হবে সে সম্পর্কে বলেছে এবং এটি আমাকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সাহস দিয়েছে।”
চিন্তিত বা বিষণ্ণ হলে শিল্প ও কারুশিল্পসহ কি ধরণের কাজ করতে হবে এখন সে জানে। তিনি জানায়, “তারা আমাকে আমার বাবা-মায়ের সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে, ঘরের কাজ করতে এবং পরিবারের সাথে বোর্ড গেম খেলতে বলেছিল। এখন আর আমার একা লাগে না”