কোভিড-১৯ মহামারীকালে আপনার পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে সুরক্ষিত রাখবেন
কিশোর-কিশোরী মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. লিসা ডামুরের সাথে আলাপচারিতা
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
< ইউনিসেফের কোভিড-১৯ পোর্টালে ফিরে যান
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বাবা-মা এবং শিশুরা বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখিন হচ্ছে। পরিবারের প্রত্যেকের জন্যই স্কুল বন্ধ ও শারীরিক দূরত্বের বিষয়গুলো মেনে নেয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের প্রত্যেকে কীভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারে এবং এই নিউ নরমাল সময়ে সবকিছুকে কীভাবে সহজ করে তোলা যায় সে সম্পর্কে আরও জানতে আমরা কিশোর-কিশোরী মনোবিজ্ঞানী, সর্বাধিক বিক্রিত লেখক, মাসিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট এবং দুই সন্তানের মা ডাঃ লিসা ডামুরের সাথে বসেছিলাম।
ইউনিসেফ: করোনভাইরাস (কোভিড -১৯) রোগ ছড়িয়ে পড়ার সময় কিশোর-কিশোরী এবং তাদের বাবা-মা কীভাবে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারেন?
ডাঃ ডামুর: বাবা-মা প্রথম যে কাজটি করতে পারে তা হলো তারা [কিশোর-কিশোরীরা] যে উদ্বিগ্ন বোধ করছে সে বিষয়টিকে স্বাভাবিক করে তোলা। অনেক কিশোর-কিশোরীর মধ্যে এক ধরনের ভুল ধারণা রয়েছে যে, উদ্বেগ সব সময় মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। তবে, মনোবিজ্ঞানীরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, উদ্বেগ একটি স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর বিষয় যা বিভিন্ন ধরনের হুমকির বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে এবং নিজের সুরক্ষা নিতে সহায়তা করে। সুতরাং আপনি যদি বলেন, “তুমি যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছো সেটা সঠিক। কিছুটা উদ্বেগের কারন তো এখন অবশ্যই আছে। বিষয়টি এইভাবেই ভাবা উচিত। এখনই যে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, উদ্বেগ তা নিতে সহায়তা করবে।” আর এধরনের ভাবনা কিশোর-কিশোরীদের জন্য খুবই সহায়ক। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অনুশীলন করা, ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং নিজের মুখ স্পর্শ না করা – এই ধরনের উদ্বেগ এখনই যা করা দরকার তোমাকে সেটি করতে সহায়তা করবে। এতে করে তুমি আরও সুরক্ষিত বোধ করবে। সুতরাং এই কাজটি আমরা করতে পারি।
আর একটা কাজ যেটা আমরা করতে পারি সেটা হলো তারা যেন বাইরের দিকে নজর দেয় সেক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে পারি। এক্ষেত্রে তাদের একথা বলুন, “শোনো, আমি জানি তোমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় সত্যিকার অর্থেই বেশ উদ্বিগ্ন। তবে, আমরা কেন তোমাদের নিজের মুখ ধোয়া, বাড়ির কাছাকাছি থাকা ইত্যাদি করতে বলছি? এর কারন হলো আমরা এভাবেই আমাদের কমিউনিটির সদস্যদের যত্ম নিই। আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষজনকে নিয়ে এভাবেই চিন্তা করি।”
এবং তারপরে তাদেরকে আরও কিছু কাজ করতে দিন যা তাদের জন্য সহায়ক হতে পারে: হয়তো অভাবগ্রস্থ মানুষদের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া বা তাদের জন্য কেনাকাটা করতে যাওয়া বা নিজেদের কমিউনিটির কোন এলাকার মানুষের সহায়তা দরকার তা নির্ধারণ করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আশেপাশের মানুষদের সহায়তা করার জন্য কাজ করা। করোনার মধ্যে অন্যদের সেবা করার উপায় খুঁজে পাবার বিষয়টি তরুণদের মধ্যে আরও ভাল অনুভূতি তৈরিতে সহায়তা করবে।
তারপর তৃতীয় যে জিনিসটি করা দরকার তা হলো উদ্বেগ থেকে বেরিয়ে আসতে তাদেরকে অন্যান্য বিষয়ের দিকে ধাবিত করতে হবে। মনোবিজ্ঞানীরা যা জানেন তা হচ্ছে যখন আমরা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মধ্যে থাকি - এটি অবশ্যই একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা যা কিছুকাল চলতে থাকে – তখন সমস্যাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা বেশ সুবিধাজনক: (১) যেসব বিষয়ে আমি কিছু একটা করতে পারি; এবং (২) যে সব বিষয়ে আমি কিছুই করতে পারি না। এখন সেই দ্বিতীয় ভাগে অনেক কিছু ঘটতে চলেছে, যেখানে শিশু কিশোরদের বেশ কিছু সময়ের জন্য হলেও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বাঁচতে হবে।
গবেষকরা জানান, দ্বিতীয় অংশটিকে মোকাবেলা করার জন্য ইতিবাচক বিভ্রান্তি খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি আমাদের সহায়তা করতে পারে: আমরা আমাদের বাড়ির কাজ করি, আমরা আমাদের পছন্দসই সিনেমা দেখি, আমরা বিছানায় শুয়ে থেকে একটি উপন্যাস পড়ি। এখনকার সময়ে এটি যথেষ্ট উপযুক্ত কৌশল। করোনভাইরাস এবং উদ্বেগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হিসাবে সম্ভবত অনেক কিছুই বলা যায়, এবং অন্যভাবে করোনভাইরাস এবং উদ্বেগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হিসাবে আবার অনেক কিছুই বলা যায় না। সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পেতে শিশু-কিশোরদের সহায়তা করা এক্ষেত্রে একটি বড় পার্থক্য নিয়ে আসবে।
ইউনিসেফ: বিভ্রান্তিবশত, ইদানিংকালে অনেক কিশোর-কিশোরীই নিজেদেরকে বিভিন্ন ডিভাইসের স্ক্রীন-এর মধ্যে আবদ্ধ রাখছে। বাবা-মা এবং কিশোর-কিশোরীরা এটিকে সর্ব্বোত্তমভাবে কীভাবে মোকাবেলা করতে পারে?
ডাঃ ডামুর: আমি একজন কিশোর বা কিশোরীর খুব সামনে এসে বলব, “ঠিক আছে, তুমি এবং আমি দুজনেই জানি যে, তোমার হাতে এখন অনেক সময় আছে। কিন্তু তুমি এবং আমি দুজনেই এও জানি যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযথা অলস সময় কাটানোর কোনও অর্থ হতে পারে না। এটি স্বাস্থ্যকরও নয়। এটি ভালো কিছু নয় এবং এটি তোমার উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তুমি বিনামূল্যে ব্যবহার করছো বলেই যে এটি ভাল তা নয়। সুতরাং আসল কথা হলো তোমাকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না বা ক্লাশ করার জন্য সময়ও ব্যয় করতে হচ্ছে না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সে সব সময় তোমাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য ব্যয় করতে হবে।” তবে, সবকিছু স্বীকার করে নিয়ে আমার মনে হয় আপনি সরাসরি শুধু বলবেন যে, স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে না যাওয়ার জন্য যে সময় বেঁচে যাচ্ছে তার সবটুকুই অনলাইনে ব্যবহারের কোনও সুযোগ নেই।
এরপর কিশোর-কিশোরীকে প্রশ্ন করুন, “আমরা বিষয়টিকে কীভাবে মোকাবেলা করবো? এক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনাই বা কি হবে? নতুন স্বাভাবিক (নিউ নর্মাল) বা নতুন স্বল্পমেয়াদী স্বাভাবিক অবস্থায় তুমি সাধারণতঃ কী প্রস্তাব করবে? তুমি যেভাবে অভ্যস্ত সেভাবে আর তোমার সময়টিকে কাঠামোবদ্ধ করা যাচ্ছে না। তাই একটা কাঠামোর চিন্তা কর এবং তোমার মনে যে কাঠামো আছে তা আমাকে দেখাও। তারপর আমরা বিষয়টি নিয়ে একসাথে ভাবতে পারি।”
ইউনিসেফ: স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের জন্য কেমন কাঠামো তৈরি করবে?
ডা. ডামুর: শিশু কিশোরদের জন্য একটা সময়সূচী দরকার। খুব দ্রুততার সাথে আমাদের সকলকে এমন একটা সময়সূচী বানাতে হবে যা তাদের সময়কে দিনের পর দিন কার্যকরভাবে ব্যয় করতে সাহায্য করবে। এবং তাই আমি দৃঢ়ভাবে সুপারিশ করব যে, বাবা-মায়েরা এক্ষেত্রে দিনের একটি সময়সূচি আছে কিনা তা নিশ্চিত করবেন। আর এ সময়সূচিতে সময়টা কীভাবে ব্যয় করা হবে তার পরিকল্পনা থাকবে। সময়সূচির এই পরিকল্পনার মধ্যে খেলার সময়ও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যেখানে তাদের ইচ্ছানুযায়ী ফোনে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তবে এই সময়সূচিতে প্রযুক্তি-মুক্ত সময়, রাতের খাবার তৈরিতে সাহায্যের জন্য আলাদা সময়, বাইরে যাবার জন্য আলাদা সময় থাকা উচিত। এছাড়াও, এরকম একটা পরিকল্পিত সময়সূচী তাদেরকে বুঝতে সাহায্য করবে কখন তারা পড়াশোনা করবে এবং কখন তারা খেলবে অথবা নিজের মত সময় কাটাবে। এই দিকনির্দেশনা তাদের জন্য বড় ধরনের স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসবে।
আমি ১০ বা ১১ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য বলব, বাবা-মার একটি কাঠামো তৈরি করা উচিত। তারপরে এটি নিয়ে তাদের সন্তানদের সাথে আলোচনা করা উচিত এবং আলোচনায় এমন কোনও প্রতিক্রিয়া কিংবা মতামত থাকতে পারে যা কাঠামোটিকে আরও উন্নত করতে পারে।
এগারো এবং তার চেয়েও বেশি বয়সী শিশুদের জন্য, আমি বাচ্চাকে এটির খসড়া সময়সূচী তৈরি করতে বলবো - এবং সময়সূচীতে যেসব বিষয় থাকা উচিত সে সম্পর্কে তাকে ধারণা দিব, এবং তারপর সে যা তৈরি করলো সেটা নিয়ে কাজ করবো।
ইউনিসেফ: আরও ছোট শিশুদের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করছেন এমন বাবা-মার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ডা. ডামুর: ছোট শিশুরা আসলে দিনের বেলা ক্লাসে বসে থাকে এবং তাদের চারপাশের অনেক সহপাঠীর দুষ্টামি এবং বিরক্তি সহ্য করে। অথচ তারা যখন বাড়িতে থাকে তখন তাদের এসব সহ্য করতে হয় না। আমি মনে করি বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে। আমি মনে করি না যে, তাদের বাড়িতে থেকে নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করার দক্ষতাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা উচিত।
একানে এটি বলা দরকার যে, প্রত্যেক পরিবার তাদের শিশুকে সবচেয়ে ভাল জানেন এবং কে তাদেরকে তদারকি করছে তার উপর নির্ভর করে তাদের আদর্শ কি হবে। এছাড়াও, তাদের দিনের সময়সূচী তৈরি করতে হবে এমন ভাবে যাতে করে যদি কোন কিছু ঘটেও যায় তবে তার আগেই সকল কাজ যেমন, স্কুলের সকল কাজ, অন্যান্য সকল কাজ, যে কাজগুলো তাদের করতে হবে তা শেষ হয়ে যায়।
অনেক পরিবার মনে করতে পারে যে, দিনটি কিছুটা পরে শুরু করা ভাল হবে। আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়া, একসাথে দীর্ঘ সময় ধরে সকালের নাস্তা করা এবং তারপরে সকাল ১০টা বা ১১টার দিকে দিনের অন্যান্য কাজ করা ভাল। প্রতিটি পরিবার তাদের নিজের মতো করে এটি করতে পারে। আমি এমন কিছু যুক্ত করতে চাই যা অন্য অনেকে বলতে নাও চাইতে পারে: আমরা এখন মহামারীতে আটকে আছি, সুতরাং আপনি যেভাবে উপভোগ করতে পারবেন – আপনার সেটাই করা উচিত। যদি এর অর্থ এমনটি হয় যে, আপনি পরিবারের সকলের সকালের নাস্তার জন্য একটি পছন্দের খাবার তৈরি করছেন এবং এটি এমন একটি বিষয় যা স্কুল চলাকালীন কখনও সম্ভব হয়নি এবং এটি এমন কিছু যা প্রত্যেককে খুশি করে তোলে, তবে অবশ্যই সেটা করুন।
একটি সময়সূচি দিয়ে চেষ্টা করুন, বা পরিবারের জন্য এক সপ্তাহের একটি অস্থায়ী সময়সূচি দিয়ে চেষ্টা করুন এবং তারপরে সপ্তাহের শেষে এটি পর্যালোচনা করুন।
“আমাদের মনে রাখা উচিত যে, তারা গাড়ির যাত্রী এবং আমরা গাড়িটি চালাচ্ছি।”
ইউনিসেফ: সংকটের সময়ে বাবা-মার নিজস্ব আচরণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ডা. ডামুর: বাবা-মায়েরা অবশ্যই উদ্বিগ্ন এবং আমরা নিজেদেরকে যতটা চিনি, আমাদের বাচ্চারা আমাদেরকে তার চেয়ে বেশি ভাল করে চেনে। তারা আমাদের আবেগকে কাজে লাগাবে। উদ্বেগ সামলানোর জন্য তাদের নিজেদের সময়ে তারা যা করতে পারে আমি বাবা-মাকে সেটা করার জন্য বলব। নিজেদের উদ্বেগ কমানোর জন্য বাচ্চারা তাদের নিজস্ব সময়ে যা করতে চায়, আমি বাবা-মাকে সেটা করতে দিতে বলবো। এর অর্থ হলো আবেগকে ধরে রাখা। বিশেষত বাবা-মা যদি সেই আবেগগুলোকে তীব্রভাবে অনুভব করে, তখন বাবা-মার পক্ষে আবেগকে ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। আমি চাই, বাবা-মায়ের তাদের উদ্বেগ প্রকাশের জন্য একটি আউটলেট খুঁজে পাক কিন্তু সেটা তাদের সন্তানদের নয়। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, তারা গাড়ির যাত্রী এবং আমরা গাড়ি চালাচ্ছি। সে কারনে আমরা যদি উদ্বিগ্ন হই, কখনো কখনো আমরা অবশ্যই হই, তাহলে আমাদের গাড়িতে চড়ে শিশুরা নিরাপদ বোধ করতে পারবো না।
ইউনিসেফ: সন্তানরা কেমন বোধ করছে- এ বিষয়ে বাবা-মায়ের তাদেরকে কি নিয়মিত জিজ্ঞাসা করা উচিত? অথবা এটি সন্তানদের জন্য আরও আবেগ বা উদ্বেগের কারণ হতে পারে কিনা?
ডা. ডামুর: এটি বাচ্চার উপর নির্ভর করে বলে আমি মনে করি। কিছু বাচ্চা আছে যারা নিজেদেরকে নিজেদের মধ্যে রাখে এবং সেক্ষেত্রে বাবা-মা বাচ্চাদের এমনটি বলতে পারেন যে, "তুমি কী করছো?" বা "তুমি কী শুনছো?" অন্য অনেক বাচ্চা এ-সম্পর্কে কথা বলবে, এবং বলেই যাবে। এই বিষয়গুলোতে আমরা যেভাবে যোগাযোগ করতে চাই তা হলো অভিব্যক্তি এবং ধারণার মধ্যে ভারসাম্য রাখা। বিশেষত যখন শিশুদের কিছুটা তীব্র অনুভূতি থাকার আশা করা উচিত, এমন সময়ে আপনি বাচ্চাদের কিছু অভিব্যক্তি এবং অনুভূতি জানতে চান। সুতরাং যদি আপনার শিশুর আবেগের মাত্রা যদি বেশি থাকে, তখন আপনি আবেগ সংবরন করে তাকে অনুভুতি প্রকাশে সাহায্য করবেন। আর যদি শিশুর প্রকাশ বাধাগ্রস্থ হয়, তখন আপনি তাকে তার সুপ্ত অনুভুতিগুলি যাতে প্রকাশ করতে পারে সে বিষয়ে সহায়তা করবেন।
ইউনিসেফ: ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হবার ব্যাপারে শিশুরা বেশ উদ্বিগ্ন, কিন্তু তারা তাদের বাবা-মার সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। বিষয়টি নিয়ে বাবা-মার কীভাবে তাদের সাথে কথা বলা উচিত?
ডা. ডামুর: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগ এবং নিজেকে এর থেকে সুস্থ রাখতে শিশুরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সে বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সাথে তাদের অভিভাবকদের অত্যন্ত শান্ত ও কায©কর কথাবার্তা হওয়া উচিত। সম্ভবত আপনি বা আপনার বাচ্চারা কোনও একটা সময় প্রায়শই সাধারণ সর্দি বা জ্বরের মতো লক্ষণ অনুভব করতে পারেন। কিন্ত এতে তাদের অযথা আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। এ বিষয়টি বাচ্চাদের জানানো উচিত। বাচ্চারা ভাল বোধ করছে না বা ভাইরাস সম্পর্কে উদ্বিগ্ন বোধ করছে - এ বিষয়টি বাবা-মাকে জানানোর জন্য বাচ্চাদের উৎসাহিত করা উচিত যাতে করে অভিভাবকরা সন্তানদের সাহায্য করতে পারেন।
শিশুরা কোভিড-১৯ সম্পর্কে ভীত এবং উদ্বিগ্ন বোধ করছে এ ব্যাপারে প্রাপ্তবয়স্করা সহানুভূতিশীল হবেন। আপনার সন্তানকে আশ্বস্ত করুন যে, বিশেষত বাচ্চা এবং অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংক্রমণের অধিকাংশ উপসগ©ই সাধারণত হালকা হয়। এটা মনে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ যে, কোভিড-১৯ এর অধিকাংশ লক্ষণই চিকিৎসা করা যেতে পারে। সেখান থেকে, আমরা তাদের মনে করিয়ে দিতে পারি যে, নিজেকে এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং পরিস্থিতির উপর আরও ভাল নিয়ন্ত্রণ রাখতে আমরা ঘন ঘন হাত ধোয়া, মুখমন্ডল স্পশ© না করা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো কার্যকর অনেক কিছুই করতে পারি।
ইউনিসেফ: করোনারভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগ সম্পর্কে প্রচুর অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য রয়েছে। এই ভুল তথ্য রোধ করতে অভিভাবকরা কী করতে পারেন?
ডা. ডামুর: তারা কী শুনছে বা কোনটাকে তারা সত্য বলে মনে করে তা খুঁজে বের করার মাধ্যমেই শুরু করা যেতে পারে। আপনার সন্তানকে কেবলমাত্র সত্য তথ্য দেওয়াই যথেষ্ট নয়। আপনার সন্তান যদি ভুল কিছু জেনে থাকে বা সঠিক নয় এমন সংবাদ দেখে তবে তারা আপনার দেয়া নতুন তথ্যের সাথে তাদের পুরানো তথ্যকে মিলাবে। কী ঘটছে সে সম্পর্কে এটি তাদেরকে এক ধরণের ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের দানবের মত ধারণা দেবে। তাই, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, “তুমি কী শুনছো? আপনি যখন তাদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেন বা যখন আপনি সর্বশেষ তাদের সাথে খেলার মাঠে উপস্থিত ছিলেন, তখন তাদেরকে কী বলা হয়েছে?” তারা ইতিমধ্যে যা জেনেছে সেটা অনুসন্ধান করুন এবং তাদের সঠিক তথ্যের কাছে নিয়ে আসার জন্য সেখান থেকে শুরু করুন। সঠিক তথ্য পাবার জন্য বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র (যেমন, ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট) ব্যবহার করতে বলুন বা কম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে তারা যে সব তথ্য পেতে পারে সেগুলো যাচাই করতে প্রাপ্তবয়স্কদের উচিত শিশুদের উৎসাহিত করা।
>> ভাইরাস থেকে আপনার এবং আপনার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে সর্বশেষতম তথ্য এবং টিপস নিন।
“যখন এক ধরনের বেদনাদায়ক অনুভূতি হয়, তখন একমাত্র উপায় হলো শেষ পর্যন্ত দেখা”
ইউনিসেফ: বিভিন্ন ইভেন্ট এবং কার্যক্রম বাতিলের কারণে হতাশায় ভুগছেন এমন শিশুদেরকে তাদের অভিভাবকরা কীভাবে সহায়তা করতে পারেন?
ডা. ডামুর: শিশুদেরকে দুঃখ পেতে দিন এবং এর জন্য তাদেরকে দোষী করার চেষ্টা করবেন না। “অন্য অনেক মানুষ তোমার চেয়েও খারাপ” তাদেরকে এমন কথা বলবেন না। এতে করে বাচ্চারা দুঃখ পাবে এবং নিজেকে দোষী মনে করবে! এটি ভাল কিছু বয়ে নিয়ে আসবে না। তাদেরকে বলুন, “তুমি সঠিক প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছ। এটা সত্যিই কষ্টের যে তুমি তোমার বন্ধুদের মতো সময় কাটাতে পারছো না। কলেজ ক্যাম্পাসে বসন্ত কাটাতে যেতে পারছো না। যে কনভেনশনটিতে যাবার জন্য তুমি ছয় মাস অপেক্ষা করেছিলে, সেটিতেও তুমি যেতে পারছো না।” একজন কিশোর-কিশোরীর জীবনে এগুলো বড় রকমের ক্ষতি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের অন্য যে জিনিসটি মনে রাখতে হবে তা হলো আমরা দীর্ঘদিন ধরে আছি তবে, আমরা এর আগে এমন পরিস্থিতির মুখামুখি কখনও হইনি। তারা এর আগে এমনটি কখনও দেখেনি এবং তারা আরও কম বয়সী। ১৪ বছর বয়সের জীবনে চার মাসের বাধাগ্রস্থতা তাদের জীবনের একটি বড় অংশ। তারা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এটি মনে রাখবে। আমাদের চেয়ে এটি তাদের জন্য একটি বড় বিষয়।
কিশোরী-কিশোরীর জীবনে এক বছর একজন প্রাপ্তবয়স্কের জীবনের সাত বছরের সমান। তাই এই ক্ষতির ক্ষেত্রে আমাদের সহানুভূতি থাকতে হবে। এটি তাদের পুরো জীবনের জন্য একটি হাইস্কুল থেকে পাস করার মতো। এটি ছিল তাদের পুরো জীবনের ক্যাম্পাসে এক ঝলক বসন্ত। এগুলো বড় ধরনের ক্ষতি। এমনকি তারা বিপর্যস্ত না হলেও কিশোর-কিশোরীদের কাছে এটি সত্যিই মন খারাপের বিষয়। এই মুহুর্তে কিশোর-কিশোরীরা যেভাবে শোক পালন করছে এবং হতাশ হয়ে পড়ছে, সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নেবার জন্য আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করবো।
প্রায় ছয় জন কিশোর-কিশোরী অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছিল। আমি তাদেরকে বললাম, “দুঃখ পাওয়া স্বাভাবিক। অবস্থাটা সত্যিই বেদনাদায়ক, তাই তোমাদের দুঃখ পাবার অধিকার রয়েছে।” যখন বেদনাদায়ক অনুভূতি আসে, তখন অপেক্ষা করাই একমাত্র উপায়। যখন আমরা মানুষজনকে দুঃখ পেতে দিই, সাধারণত তারা আরও দ্রুত ভালো বোধ করে। সুতরাং, সহানুভূতি এবং সমর্থন তাদের প্রাপ্য। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন দেয়াই আমাদের কাজ। মনে রাখতে হবে তারা সঠিক প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে।
ইউনিসেফ: যে সব কিশোর-কিশোরী একাকীত্ব বোধ করছে এবং বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য কম©কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ডা. ডামুর: এখন আমরা সম্পূর্ণ নতুনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রশংসা করতে পারি! যদিও কিশোর-কিশোরী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে প্রাপ্তবয়স্কদের বিরূপ মনোভাব থাকতে পারে, তবে কিশোর-কিশোরীরা তাদের বন্ধুদের সাথে থাকতে চায়। শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকা অবস্থায় তারা তাদের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইতেই পারে! উপরন্তু, আমি কিশোর-কিশোরীদের সৃজনশীলতাকে কখনই খাটো করে দেখতে চাই না। আমার ধারণাটা হলো তারা একে অপরের সাথে অনলাইনে খেলার উপায় খুঁজে পাবে এবং তারা আগে যা করেছে এটি তার থেকে আলাদা। এবং তাই সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে আমি এখনই বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি রাখব না।
ইউনিসেফ: এই কঠিন অনুভূতির মধ্য দিয়ে কাজ করতে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে কিশোর-কিশোরীরা কি কি মাধ্যম ব্যবহার করতে পারে?
ডা. ডামুর: প্রতিটি শিশু ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে এটা করবে বলে আমি মনে করি। কোন কোন শিশু শিল্পকর্ম© তৈরি করতে চলেছে, কোন কোন শিশু তাদের বন্ধুদের সাথে কথা বলতে চায় এবং ইন্টারনেটে সংযুক্ত থেকে তাদের দুঃখকে ভাগাভাগি করতে চায়। এমন সময় তারা এটা করতে চায় যখন তারা কেউ একসাথে হতে পারে না। কোন কোন শিশু খাদ্য মওজুদের জায়গাগুলো থেকে খাবার পাবার উপায় খুঁজতে চাইছে। আমি শুধু বলব, আপনার সন্তানদের জানুন, আপনার সন্তানের কাছ থেকে ইঙ্গিত নিন এবং সত্যিকারের বাধা-বিপত্তি খুঁজে পাওয়ার সাথে অনুভূতি সম্পর্কে কথা বলার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করুন এবং যখন তাদের মন খুব খারাপ থাকে তখন তাদের খারাপ লাগা থেকে মুক্তি দিতে বাধা-বিপত্তির বিষয়টি মেনে নিন।
ইউনিসেফ: করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকে কিছু শিশু স্কুলে বা অনলাইনে হয়রানীর শিকার হচ্ছে। কোন শিশু যদি গালাগালির শিকার হয় তবে তাদের কী করা উচিত?
ডা. ডামুর: যে কোনও ধরণের অনলাইন হয়রানী মোকাবেলার সেরা উপায় হলো বাইন্ড্যান্ডারদের সক্রিয় করা এবং ব্যবহারকারী শিশুদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। এর পাশাপাশি, সকল বাবা-মার তাদের সন্তানদের বলা উচিত যে, তারা যদি গালাগালি বা হয়রানীর শিকার হয়, তবে তাদের সাহায্য করতে পারে এমন কোনও প্রাপ্তবয়স্কের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
>> সাইবারবুলিং: এটা কী এবং এটা কীভাবে বন্ধ করতে হয়?
>> আপনার সন্তানের সাথে বুলিং সম্পর্কে কীভাবে কথা বলা যায়?
ইউনিসেফ: বাবা-মা এরকম বন্দী পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বেশি কীভাবে কাজে লাগাতে পারে? একসাথে বাড়িতে আটক অবস্থায় আপনি আপনার সন্তানদের সাথে কিভাবে মজার সময় কাটাতে পারেন?
ডা. ডামুর: আমার বাড়িতে আমার দুই মেয়ে আছে। প্রতি রাতে আমরা একটি ডিনার টিম বানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাতের খাবারের দায়িত্বে কে থাকবে সেটা নিয়ে আমরা একটি সময়সূচি তৈরি করতে যাচ্ছি এবং কখনও কখনও এটি আমি কিংবা আমার স্ত্রীও হতে পারে। আবার কখনও কখনও এটি আমি কিংবা আমার দুই মেয়ের যে কোন একজনও হতে পারে। আমরা আসলে এটাকে একটা জোড়া হিসাবে দাঁড় করাতে চাই। আমার বড় মেয়ে কিশোরী এবং আমার ছোট মেয়ে প্রাথমিক-স্কুলে যাওয়ার বয়সী। এ কারনে এমন এক রাত আসবে যেখানে আমার দুই মেয়েকে রাতের খাবারের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই আমরা পরিবারের জন্য রাতের খাবার তৈরির দায়িত্বকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিই। পরিবারের সকলে মিলে প্রায়শই আমরা রাতের খাবার তৈরির সময় পাই না। এমনকি একসাথে রান্না করার আনন্দ উপভোগ করার জন্য দিনেও সাধারণত সময় হয়না। এ কারনে এখন আমরা এটি করছি।
আমি নিজে যা করতে চাই তার সবগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে চলেছি: আমি যে বইগুলো পড়তে চাই এবং আমি যা করতে চেয়েছিলাম সেই জিনিসগুলো করা – আমার ছোট মেয়ে বুনন শেখানোর কথা বলতো। কীভাবে বুননের কাজ করতে হয় সেটা আমি আমার ছোট মেয়েকে শেখাতে চাচ্ছি। সে যদি এখনও বুনন শিখতে আগ্রহী হয়, তবে আমরা তাই করবো! আমরা প্রতি তিন বা চার রাতে একটি মুভি নাইট রাখার কথা ভাবছি এবং যে দল রাতের খাবার তৈরির দায়িত্বে থাকবে তারাই মুভি বা সিনেমা নির্ধারণ করবে বলে আমরা ভাবছি। প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব গতি এবং সংস্কৃতি রয়েছে। কাঠামো নির্ধারণ করা ও গুমোট বাতাস থেকে তাদের বের করে আনাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। তবে, আমরা এটি করতে পারি এবং আমাদের সন্তানদের জন্যও এটি প্রয়োজন।
< ইউনিসেফের কোভিড-১৯ পোর্টালে ফিরে যান
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ম্যান্ডি রিচ, ডিজিটাল কনটেন্ট লেখক, ইউনিসেফ, সংক্ষিপ্ততা ও স্পষ্টতার জন্য এডিট করা হয়েছে।
এই নিবন্ধটি মূলত ২০২০ সালের ২৭ মার্চ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৪ অগাস্টে এটি আপডেট করা হয়েছে।