কয়েক দশক ব্যাপী কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রভাব ঠেকাতে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য জরুরি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ – ইউনিসেফ
সংস্থাটি বলছে, এখনই পদক্ষেপ নেওয়া হলে সব শিশুর জন্য অধিকতর সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তা এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী এবং আরও ভালো ভবিষ্যৎ নির্মাণে অবদান রাখবে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
কাঠমান্ডু, ৯ ডিসেম্বর ২০২১: ইউনিসেফের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত সংস্থাটির নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে সরকারগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে কোটি কোটি শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য - বিশেষ করে যাদের জীবন কোভিড-১৯ মহামারি এবং অন্যান্য দুর্যোগের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে - তাদের মৌলিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুরক্ষা সেবায় জরুরিভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ।
‘দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের জন্য সুযোগ পুনরুজ্জীবিত করা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের ৬০ কোটি শিশুর মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা শিশুদের ওপর মহামারিটি যে অসম প্রভাব ফেলেছে তা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরুরি স্বাস্থ্য, টিকাদান, পুষ্টি, সুরক্ষা ও শিক্ষার মতো সেবাগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া না গেলে, কোভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব কয়েক দশক বিরাজ করবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মানবিক বিপর্যয় এবং খরা, বন্যা ও বায়ু দূষণের মতো জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগগুলো শিশুদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে।
মহামারির আগে, দক্ষিণ এশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোর একটি, যেখানে এই প্রবৃদ্ধিকে আরও জোরদার করতে একটি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী ছিল এবং এই অঞ্চলে শিশুদের জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও অর্জিত হচ্ছিল। গত ২৫ বছরে শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেকেরও বেশি কমেছে এবং ২০০০ সাল থেকে খর্বাকৃতির সমস্যায় ভোগা শিশুদের সংখ্যা কমেছে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। শিশুদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ক্রমাগত বেড়েছে এবং ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ের হারও কমে এসেছে। এই অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী এখন নিরাপদ খাবার পানি পায়।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, “সাম্প্রতিক দশকে শিশু অধিকারের অগ্রগতিতে আমাদের অঞ্চলে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা এখন ঝুঁকির মধ্যে। যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তবে কোভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে। তবে এখন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে, আমরা সুযোগগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি এবং এটা নিশ্চিত করতে পারি যে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি শিশু কেবল টিকেই থাকবে না, বরং সমৃদ্ধি লাভ করবে।”
প্রতিবেদনটি মৌলিক স্বাস্থ্য ও টিকাদান পরিষেবাগুলো সম্পূর্ণরূপে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সহায়তা করার মতো তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করে। তবে একইসঙ্গে এই মহামারির কাছ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেছে এবং নতুন যে সুযোগগুলো তৈরি হয়েছে তার রূপরেখাও তুলে ধরেছে, যা এখন সব শিশুর উপকারে কাজে লাগানো সম্ভব।
এর মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলো, যা কোভিড-১৯ আরও ভালোভাবে মোকাবিলার জন্য চালু করা উন্নত কোল্ড চেইন ও অক্সিজেন অবকাঠামোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যান্য সুযোগের মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কথোপকথন বৃদ্ধি, যা চাহিদাগুলো শনাক্তকরণে ও আরও পরিষেবার চাহিদা তৈরিতে সহায়তা করছে এবং এই অঞ্চলের গভীর ডিজিটাল বিভাজনের দূর করার প্রয়োজনকে তুলে ধরেছে।
ইউনিসেফ বলেছে, শিশুদের অগ্রগতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি বিনিয়োগের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ মহামারির ঢেউ মোকাবেলা করার জন্যও এই অঞ্চলের প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।
জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, “একের পর এক নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটলেও দক্ষিণ এশিয়ার মাত্র ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়েছে, যার ফলে পরিবারগুলো এখনও বিপজ্জনকভাবে অরক্ষিত। বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে অবশ্যই কোভিড-১৯ টিকার ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। মহামারিটি সবার জন্য শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও জন্যই শেষ হবে না।”
শিশুদের ওপর মহামারির অসম প্রভাবের বিষয়টি “আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের অধিকার, আমাদের কথা” শিরোনামের একটি যুব বিবৃতিতে পুনর্ব্যক্ত করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের প্রায় ৫০০ জন তরুণ-তরুণীকে সম্পৃক্ত করে বিশদ ভার্চুয়াল আলোচনার ফলাফল।
“কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। আমাদের স্কুলগুলো বন্ধ থেকেছে, অনেক ক্ষেত্রে মাসের পর মাস ধরে বন্ধ থেকেছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো কখনোই আর স্কুলে ফিরতে পারবো না,” বলা হয়েছে এই বিবৃতিতে, যা ইউনিসেফ, সাউথ এশিয়া অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) সহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে। “আপনার পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ জনগোষ্ঠীর জীবন বদলে দিতে পারি।”
প্রতিবেদনে শিশুদের অগ্রগতিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি শিশুর জন্য আরও ভালো একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
১. শিশু-সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশু এবং তাদের পরিবারের জন্য।
২. সশরীরে স্কুলে উপস্থিত হয়ে পড়াশোনা চালুর পাশপাশি পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ নেওয়া, এই অঞ্চলের ডিজিটাল বিভাজন দূর করার এবং প্রতিটি শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
৩. আরও শক্তিশালী সমন্বিত জাতীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা শিশুদের প্রাণঘাতী কিন্তু চিকিৎসাযোগ্য রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখবে এবং এই অঞ্চলের শিশুদের পুষ্টি সঙ্কট দূর করে।
৪. অবহেলা ও শোষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা এবং সব শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করা।
৫. জলবায়ু অভিযোজন এবং শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোতে স্থিতিস্থাপকতার অর্জনের লক্ষে বর্ধিত বিনিয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহন করা।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর কারণে জরুরি সেবা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার অতিরিক্ত শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এর পাশাপাশি প্রায় ৫৩ লাখ শিশু গুরুত্বপূর্ণ টিকা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়ে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ লাখ বেশি। ২০২০ সালে অতিরিক্ত ৩৮ লাখ ৫০ হাজার শিশু শীর্ণকায় হয়ে বেড়ে উঠেছে বা শারীরিক দুর্বলতায় ভুগেছে বলে ধারনা করা হয়।
অন্য প্রায় সব অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিন এশিয়াতে স্কুলগুলো বেশিদিন বন্ধ ছিল। ৪০ কোটিরও বেশি শিশু ও তাদের শিক্ষকদের এমন একটি অঞ্চলে দূরশিক্ষণ ব্যবস্থায় যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, যে অঞ্চলে দূরশিক্ষণ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগ ও যন্ত্র কেনার সক্ষমতা কম। এটা পড়াশোনার সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আশঙ্কজনক অসমতার সৃষ্টি করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র শিশু, মেয়ে ও শারীরিকভাবে অক্ষম শিক্ষার্থীরা অসমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেন, “আজকের সঙ্কট সব শিশুর চাহিদা পূরণ করতে পারে – এমন শক্তিশালী ও অভিযোজিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার এক অনন্য সুযোগ উপস্থাপন করেছে। কোনো শিশু যাতে পেছনে পড়ে না থাকে তা নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকার, ব্যবসা খাত, সুশীল সমাজ ও শিশুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।”
###
সম্পাদকদের জন্য নোট:
গণমাধ্যম বিষয়ক যোগাযোগ
ইউনিসেফ সম্পর্কে
বিশ্বের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছাতে বিশ্বের কঠিনতম কিছু স্থানে কাজ করে ইউনিসেফ। ১৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে সর্বত্র সব শিশুর জন্য আরও ভালো একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে আমরা কাজ করি। শিশুদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করতে, তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে এবং তাদের মধ্যে থাকা সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করতে ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক কার্যালয় (আরওএসএ) আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ইউনিসেফের কার্যালয়ের সঙ্গে কাজ করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের জন্য ইউনিসেফের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য ভিজিট করুন: www.unicef.org/rosa এবং ইউনিসেফ আরওএসএকে অনুসরণ করুন Twitter ও Facebook-এ।
কোভিড-১৯ সম্পর্কিত আরও তথ্যের জন্য ক্লিক করুন এখানে।