কোভিড-১৯ মহামারী যখন তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছে, ২৩টি দেশে এখনও স্কুল পুরোপুরি চালু হয়নি, যা শিক্ষাকে ‘সবচেয়ে বড় বিভাজকে’ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে - ইউনিসেফ
সম্প্রতি উঠে আসা তথ্য-প্রমাণ বলছে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যা বাড়তে চলেছে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
নিউইয়র্ক/ঢাকা, ৩০ মার্চ ২০২২ – আজ প্রকাশিত ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারী যখন তৃতীয় বছরে পদার্পণ করছে, তখনও ২৩টি দেশে স্কুলগুলো পুরোপুরি খুলেনি । ওইসব দেশে প্রায় ৪০ কোটি ৫০ লাখ স্কুলগামী শিশুর বসবাস এবং এই শিশুদের অনেকে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবেদনে যেসব দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে সেই দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। দেশটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং এখানে শিশুরা প্রায় ১৮ মাস সশরীরে স্কুলের পড়াশোনা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
‘শিশুরা কি সত্যিই শিখছে?’ শীর্ষক ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনে শিশুদের ওপর কোভিড-১৯ মহামারী এবং এ কারণে স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের জাতীয় পর্যায়ের উপাত্ত এবং একইসঙ্গে মহামারীর আগের সময়ে শিশুদের শিক্ষার অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে হালনাগাদ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত ২ বছরে প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ শিশু সশরীরে স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রমের অর্ধেকের বেশি হারিয়েছে। এতে বৈশ্বিকভাবে সশরীরের স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রমের ২ ট্রিলিয়ন ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং পুনরায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শুধু শিক্ষাই ব্যাহত হয়নি, এ কারণে তাদের পড়তে ও গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতার ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। যদিও এই ঘাটতি মহামারীর আগেও ছিল।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৃতীয় গ্রেডে অধ্যয়নরত শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশের পড়তে পারার এবং মাত্র ১৮ শতাংশের গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ।
প্রতিবেদনে পড়তে পারার দক্ষতা বিচারে গত এক বছরে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পার্থক্যের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের মাত্র ২৯ শতাংশের পড়তে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে, যেখানে স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে এই হার ৩৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, “মহামারীর আগেও বাংলাদেশের শিশুরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিল। কোভিডে বাংলাদেশের শিশুদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে তাদের জন্য প্রতিকারমূলক শিক্ষা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে তা পরবর্তী প্রজন্মের শিশু ও তাদের পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।”
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, “শিশুরা যখন তাদের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে না, তখন তাদের শেখার ক্ষতি হয়। যখন তারা একেবারেই যোগাযোগ করতে পারে না, তখন তাদের শেখার ক্ষতি স্থায়ী হতে পারে। শেখার সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থ হল শিক্ষা সবচেয়ে বড় সমতা বিধায়ক হওয়ার পরিবর্তে সবচেয়ে বড় বিভাজকে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যখন বিশ্ব তার শিশুদের শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন আমরা সবাই এর পরিণতি ভোগ করি।”
পড়াশোনার ক্ষতি সম্পর্কিত উপাত্ত ছাড়াও প্রতিবেদনে ক্রমবিকাশমান তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে, যা নির্দেশ করে যে, শ্রেণিকক্ষ পুনরায় খুলে দেওয়ার পর অনেক শিশু স্কুলে ফিরে আসেনি। লাইবেরিয়ার উপাত্ত দেখায় যে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দেওয়ার সময় সরকারি স্কুলের ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ফিরে আসেনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে তিনগুণ বেড়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার হয়েছে। উগান্ডায় প্রায় দুই বছর ধরে স্কুলগুলো বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে স্কুলগুলো পুনরায় খোলার পর স্কুলগামী শিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন স্কুলে ফেরেনি। মালাবিতে ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ৬.৪ শতাংশ থেকে ৪৮ শতাংশ বেড়ে ৯.৫ শতংশে পৌঁছেছে। কেনিয়ায় ১০-১৯ বছর বয়সী ৪ হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, স্কুলগুলো পুনরায় খোলার পর ১৬ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ও ৮ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী স্কুলে ফেরেনি।
স্কুলের বাইরে থাকা শিশুরা সমাজের সবচেয়ে অরক্ষিত ও প্রান্তিক শিশুদের অন্যতম। তাদের পড়তে, লিখতে বা প্রাথমিক স্তরের গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারার সক্ষমতা সাধারণত সবচেয়ে কম এবং স্কুলগুলো যে নিরাপত্তা প্রদান করে তা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকে, যা তাদের নিগ্রহ এবং জীবনভর দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে ফেলে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, যদিও স্কুলের বাইরে থাকা শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, তবে ৩২টি দেশ ও অঞ্চলে মহামারীর আগের সময়ের উপাত্ত অত্যন্ত নিম্ন স্তরের শিক্ষার চিত্র তুলে ধরছে এবং সম্ভবত মহামারীর কারণে পড়াশোনার যে মাত্রার ক্ষতি হয়েছে তাতে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। যেসব দেশের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেসব দেশে শেখার বর্তমান গতি এতটাই ধীর যে বেশিরভাগ স্কুলগামী শিশুর পড়তে পারার প্রাথমিক দক্ষতা শিখতে ৭ বছর লাগতে পারে, যে দক্ষতা সাধারণত ২ বছরেই অর্জন করা যায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ের গাণিতিক দক্ষতা অর্জনে ১১ বছর লাগতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে, স্কুলগামী শিশুরা যে প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞান অর্জন করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে ৩২টি দেশ ও অঞ্চলের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেখানে প্রায় ১৪ বছর বয়সী বা অষ্টম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের এক চতুর্থাংশের পড়তে পারার প্রাথমিক দক্ষতা ছিল না। অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর ছিল না গাণিতিক দক্ষতা যা জসাধারণত ৭ বছর বয়সী বা দ্বিতীয় গ্রেডের শিক্ষার্থীদের থাকার কথা।
ক্যাথরিন রাসেল বলেন, “মহামারীর আগেও সবচেয়ে প্রান্তিক শিশুদের পেছনে ফেলে রাখা হচ্ছিল। আর মহামারী যখন তৃতীয় বছরে পা রাখছে, তখন আমাদের ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া সুযোগ নেই। আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি, শিশুদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের শেখার অবস্থা কী তা মূল্যায়ন করা। তারা যা হারিয়েছে তা পুনরুদ্ধার করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় নিবিড় সহায়তা প্রদান এবং শিক্ষকরা যাতে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা উপকরণ পায় তা নিশ্চিত করা। এগুলো করতে না পারলে অনেক বেশি ঝুঁকি তৈরি হবে।”
###
হাই-রেস ছবি ডাউনলোড করুন এখানে
সম্পাদকদের জন্য নোট:
সূত্র: ইউনেসকো ইউআইএস, উগান্ডা ন্যাশনার এক্সামিনেশন বোর্ড স্টাডি (২০২১)
স্কুলের বাইরে থাকা শিশু বলতে সেই শিশুদের বোঝানো হয় যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সী, কিন্তু স্কুলে ভর্তি হয়নি। এরা সেই স্কুলগামী শিশুদের থেকে আলাদা যাদের স্কুল কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে।
গণমাধ্যম বিষয়ক যোগাযোগ
ইউনিসেফ সম্পর্কে
বিশ্বের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছাতে বিশ্বের কঠিনতম কিছু স্থানে কাজ করে ইউনিসেফ। ১৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে সর্বত্র সব শিশুর জন্য আরও ভালো একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে আমরা কাজ করি।
ইউনিসেফ এবং শিশুদের জন্য এর কাজ সম্পর্কিত আরও তথ্যের জন্য ভিজিট করুন: www.unicef.org.
ইউনিসেফকে অনুসরণ করুন Twitter, Facebook, Instagram এবং YouTube-এ।