সংকটের মধ্যে সংকট: অগ্নিকাণ্ডে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুরা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন
কক্সবাজারের অগ্নিকাণ্ড পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পর ইউনিসেফ শিশুদের তাদের অভিভাবকদের সাথে পুনরায় মিলিত করতে কাজ করছে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
ছোট বোনের সঙ্গে খিল-খিল করে হাসতে থাকা আট বছর বয়সী নাজুমকে* দেখে বোঝার উপায় নেই যে ২০২২ সালের মার্চ মাসে কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে বাড়িতে আগুন লেগে সে প্রায় মরতে বসেছিল।
এ নিয়ে ৫ নম্বর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। এতে শত শত আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হয় ও নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গা পরিবারগুলো যত্রতত্র পালাতে বাধ্য হয়। আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে নাজুম ও তার ১১ মাস বয়সী বোন জাহানারার* মতো অনেক শিশুই তাদের বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
নাজুমের বাবা সোহিতা যখন তার দুই মেয়েকে খুঁজে না পাওয়ার সেই ভয়াবহ মুহূর্তের কথা বর্ণনা করছিলেন, নাজুম তখন মনের আনন্দে খেলছিল। ছোট মেয়েটি যে বিপদের মধ্যে ছিল এবং দুর্যোগের পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তার বাবা-মা যে মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গেছেন - সে বিষয়ে তার নির্বিকার ভাব দেখে মনে হচ্ছিল সে সবই ভুলে গেছে।
আগুন যখন লাগে তখন এই পরিবারের সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মানুষের আর্ত চিৎকার ও ছোটাছুটির শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। আগুন দেখার আগেই তারা ধোঁয়ার গন্ধ টের পায়।
সোহিতা বলেন, “মনে আছে, আমি আতঙ্কিত হয়ে সবাইকে দৌড়াতে বলেছিলাম। সর্বত্র শিশুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং আমরা সবাই ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে আগুন থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে চলে যাই।”
চার ঘণ্টা পর আগুন যখন নেভানো হলো, সোহিতা টের পেলেন যে তার ছোট মেয়ে জাহানারা ও নাজুম নিখোঁজ। প্রতিবেশীদের কেউ তাদের দেখেনি!
“আমি শেষবার তাদের আমার সামনে আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখি। এরপর তারা ধোঁয়ায় অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আমি ভেবেছিলাম তারা নিরাপদেই আছে,” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিলেন তিনি।
সোহিতা ও তার স্ত্রী আয়েশার জন্য এটি ছিল তাদের জীবনের দীর্ঘতম রাতের শুরু। জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার চূড়ান্ত সময়ে মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ইতোমধ্যে অকল্পনীয় ক্ষতির শিকার হয়েছেন তারা। নিজেদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনের আশায় তারা বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু আগুন এবং মেয়েদের চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয় তাদের সেই শান্তি নস্যাৎ করে দেয়।
পরদিন সকাল
সকালে সোহিতা জানতে পারেন, তার নিজেরটাসহ পাঁচ শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র আগুনে পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, যা অন্তত দুই হাজার মানুষকে গৃহহীন করেছে।

একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মসজিদ ও গণ স্নানাগারসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনাও ধ্বংস হয়ে গেছে। হট্টগোলের মধ্যে কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
আগুনে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে শুনে সোহিতার মন কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন যে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অনেক শিশুকে আশ্রয়কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের হেফাজতে রাখা হয়েছে তখন তার মন শান্ত হয়।
“আমি খুশি হবো নাকি দুঃখ পাবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি চাচ্ছিলাম না আমার পরিবারকে বেশি আশা দিতে। তাই কাউকে কিছু না বলে আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম,” বলেন সোহিতা।
শিশুদের তাদের পরিবারের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত করার জন্য ইউনিসেফের সহায়তাপ্রাপ্ত ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হেল্প ডেস্কগুলোর একটিতে ছুটে গিয়ে সোহিতা নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! দেখলেন, নাজুম ও জাহানারা খেলছে। তারা নিরাপদে ও একসঙ্গে ছিল।
পরিবারগুলোকে পুনরায় একত্রিত করা গুরুত্বপূর্ণ
ইউনিসেফ বাংলাদেশের ইমার্জেন্সি ম্যানেজার মাইকেল জুমা বলেন, “শিশুরা যখন তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তারা যৌন নির্যাতন, পাচার ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাসহ বিশেষ করে শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। তাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।”
তিনি বলেন, “এটি মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যয়কর একটি অভিজ্ঞতা, যা শিশুদের সুরক্ষা ও বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে তাদের পুনরায় একত্রিত করার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা।”
সোহিতা ও আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ইউনিসেফ মনোসামাজিক সহায়তা দিচ্ছে। আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্থাপনাগুলো পুনরায় মেরামত করা হচ্ছে।
যাদের ঘরগুলো পুনরায় নির্মাণ করা হচ্ছে, সেসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যতক্ষণ না বাড়ি ফিরে আবার জীবন শুরু করতে পারবে, ততক্ষণ তারা ইউনিসেফের সহায়তাপ্রাপ্ত একটি অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্রে অবস্থান করবে।
যদিও অগ্নিকাণ্ডে সোহিতা তার নিজের সবকিছুই হারায়, তবে সে তার পরিবারকে পুনরায় একত্রিত করতে সক্ষম হয়। এতে তার যন্ত্রণা দ্রুতই স্বস্তি ও আনন্দে পরিণত হয়।
*তাদের প্রকৃত নাম নয়