শৈশবে বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রারম্ভিক যত্ন
এটা একটা বিনিয়োগ, ব্যয় নয়
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
চ্যালেঞ্জ
প্রারম্ভিক শৈশব হচ্ছে সেই সময়টা যখন শিশুর যত্ন ও বেড়ে ওঠার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি খেয়াল করা প্রয়োজন। শিশুর জন্মের পর প্রথম আট বছর তার বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। এটি সময়টি পরিবর্তনের এবং সে পরিবর্তন শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের।
তবে শিশুর প্রথম তিন বছর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
এ সময়ে শিশুর মস্তিস্ক নমনীয় থাকে এবং দ্রুত বিকশিত হয়। শিশুর ভালো ও খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো মস্তিস্কের বৃদ্ধির ওপর কড়া প্রভাব ফেলে । এই সময়ে অবহেলা বা নির্যাতন শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আচরণ ও আবেগের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করে।
শিশুর বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক উপাদান- পুষ্টি, উদ্দীপনা, সুরক্ষা ও শিক্ষা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিশু, বাবা-মা ও সেবাদাতাদের সক্ষম করে তোলার সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। সে কাজ সমূহকে বলা হয় প্রারম্ভিক শৈশব সেবা বা আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অথবা 'ইসিসিডি'।
বাংলাদেশে অধিকাংশ অভিভাবকের শিশুর সঠিক যত্ম ও প্রতিপালন সম্পর্কে জ্ঞান এখনও বেশ সীমিত। বাবা-মা কাজে থাকার সময় ছোট শিশুরা যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
শিশুর শিক্ষাগত সাফল্যের জন্য অভিভাবকরা খুব বেশি যত্মশীল হলেও অধিকাংশই জানেন না যে, উদ্দীপনা ও নিরাপত্তার অভাব শিশুর শ্রেণিকক্ষের কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে শিশুর প্রাথমিক বিকাশের চ্যালেঞ্জগুলো সহিংস আচরণ, জ্ঞানের সীমিত সুযোগ এবং মৌলিক সেবাগুলোর ঘাটতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতি চারটি শিশুর মধ্যে তিনটি শিশু মানসিক নির্যাতনের এবং প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুটি শারীরিক শাস্তি ভোগ করেছে।
বস্তি, প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল এবং সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিশু, যাদের মৌলিক সেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত, তারাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
এক থেকে আট বছর বয়সী ৮০ শতাংশের বেশি শিশু পরিবারের সদস্যের কাছ থকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ঃ মিকস ২০১৩

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশের বাড়িতে পড়ার জন্য তিনটির বেশি বই আছে

তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রারম্ভিক শিক্ষা গ্রহণ করে
শহরের কল-কারখানায় কর্মরত মায়েদের অবস্থা শোচনীয়। চাকরির পাশাপাশি অভিভাবকের দায়িত্ব পালনে হিমশিম খেতে হয় তাদের। বাংলাদেশে প্রায় ৩২ লাখ নারী তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। শহরের এসব শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসা। তৈরি পোশাক কারখানায় ইউনিসেফ পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের অর্ধেকেই বলেছেন, কার্যত সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন তারা।
দ্রুত নগরায়ন এবং লোকজনের শহরমুখী হওয়া, তা স্বেচ্ছায় বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাধ্য হয়েই হোক না কেন, দুটো বিষয়ই সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করছে।
শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশকে (আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্য একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার।
কিন্তু নীতিমালার সফল বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তার জন্য বিনিয়োগ করা প্রয়োজন এবং তা করতে হবে বিভিন্ন খাতের সমন্বয় এবং পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে।
বলাই বাহুল্য যে, শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ করার স্বদিচ্ছা না থাকলে, একটা অপেক্ষাকৃত তরুণ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়বে।
সঠিক প্রারম্ভিক বিকাশ না হলে, শিশুরা শিক্ষা ক্ষেত্রে সীমিত অর্জন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরনির্ভরতা, অধিকমাত্রায় সহিংসতা ও অপরাধ, মাদক সেবন ও নৈরাজ্যের মাঝে ডুবে যেতে পারে
সমাধান
সরকারের আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নীতিমালা প্রণয়নে ইউনিসেফের বড় ভূমিকা রয়েছে। এই ধারণাকে জনপ্রিয় করা, মূল নীতিগুলো উপস্থাপন, কারিগরি সহায়তা ও সমন্বয়ের পাশাপাশি নেটওয়ার্কিং ও অংশীদারিত্ব জোরদারে ভূমিকা রেখেছে ইউনিসেফ।
বাড়ন্ত শিশুদের বিকাশে অত্যাবশ্যক উপাদানগুলোর সরবরাহ নিশ্চিতে একটি কার্যকর পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য থেকে কমিউনিটি উন্নয়ন পর্যন্ত সব খাতের অভিন্ন লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। ইউনিসেফ বাংলাদেশ তার ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল মেয়াদি কর্মসূচিতে এই সমন্বয় ঘটিয়েছে, যা এখন সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের বাবা-মা ও তাদের সেবাদাতারা শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়েই নিমগ্ন থাকেন। কিন্তু শিশুর বিকাশ নিশ্চিত করতে তাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে।
তিন বছরের বেশি বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে খেলাধুলা, শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের যত্ন নিলেই চলবে। তবে নির্যাতন থেকে সুরক্ষা এবং পয়ঃনিষ্কাশন এবং হাইজিন বিষয়গুলোতে উদাসীনতা দেখালে হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউনিসেফের সাহায্যে পরিচালিত ৪,০০০ পাড়া সেন্টারের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক যত্নের সব সেবা দেওয়া হয়। প্রারম্ভিক বিকাশের স্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এগুলো অনুকরণীয় মডেল
ইউনিসেফের পরিকল্পনায় সাধারণত সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং তাদের পরিবার ও সেবাদাতারা বেশি গুরুত্ব পায়। ভোগোলিক অবস্থান, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং মৌলিক সেবাগুলো সম্পর্কে কতটুকু জানে তার ভিত্তিতে এই সব এলাকা নির্বাচন করা হয়।
শহুরে বস্তি, চা বাগান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউনিসেফ পরিচালিত কর্মকাণ্ডের আওতায়ই শৈশবকালীন বিকাশের প্রয়োজনীয় সেবাগুলো দেওয়া হয়।
শহরের করপোরেট অফিস ও কল-কারখানায় কর্মরত নারীদের সন্তানের যত্ন নেওয়া এবং তাকে বুকের দুধ পান করানোর অধিকার নিশ্চিত করতে চায় ইউনিসেফ।
এটাই মানব সম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ, যা একটি দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায় - বিষয়টি বিশ্বজুড়ে ইউনিসেফের কার্যক্রমেই প্রমাণিত হয়েছে।