প্রতিবারে এক জোড়া হাত দিয়ে এখন রোহিঙ্গা শিশুরা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে
করোনাভাইরাসের মতো রোগগুলো শরণার্থীদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। তবে, সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস এই রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
কক্সবাজার, বাংলাদেশ - করোনাভাইরাস রোগের (কোভিড-১৯) বিস্তার কমিয়ে আনতে এবং নিজেদের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ শারীরিক দুরত্ব অনুশীলন করাসহ বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করছে।
মিয়ানমার থেকে আসা ৮ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কার্যত বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে অবরূদ্ধ অবস্থায় বসবাস করছে। এসব শরণার্থীদের কাছে সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যদের থেকে কিছুটা দূরে থাকার বিষয়টি বলা সহজ হলেও করা কঠিন। দুর্বল বাঁশ ও তেরপল দিয়ে তৈরি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অনেক শরণার্থী বাস করে। সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকিসহ দৈনন্দিন জীবনের সব ধরনের বিপদই রয়েছে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে।
এর অর্থ এই নয় যে, কোভিড-১৯ এর মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাসের জন্য সাবধানতা অবলম্বনের কোন সতর্কতা কক্সবাজারে বসবাসকারীদের নেই। আসলে, সেখানকার অনেক শিশুই ইতোমধ্যে নিজেদের সুরক্ষার জন্য ভালভাবে ও নিয়মিত হাত ধোয়ার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছে।
আড়াই বছর আগে এসব আশ্রয়শিবিরে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের পানি বা স্যানিটেশন সুবিধাদি তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। বড় রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ) সম্পর্কিত সেবাসমূহ চালু’র ব্যবস্থা করতে ইউনিসেফ ও তাদের অংশীদাররা দ্রুততার সাথে এগিয়ে এসেছে।
এছাড়াও, ২০১৯ সালের শেষের দিকে ইউনিসেফ প্রায় ২,৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে হাত ধোঁয়ার জায়গা ছিল। হাত ধোয়ার জায়গায় সাবান ও পরিস্কার পানি সরবরাহ করা হতো। যার ফলে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার উপায়সহ সুস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত পাঠ আগেভাগেই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শিশুর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল।
যদিও কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসাবে শিক্ষাকেন্দ্রগুলো অস্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে, তবে ইউনিসেফ তার ওয়াশ কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এর মাধ্যমে ২ লক্ষ ৪০ হাজার শরণার্থীর - যাদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু- জন্য নিরাপদ পানি ও সাবান সরবরাহ করা হচ্ছে।
নতুন হুমকির ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন
শিক্ষাকেন্দ্রগুলো অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত যেসব অনুশীলন শিশুরা পেয়েছে সেগুলো যে কোন সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে যদিও শিশুরা শিক্ষাকেন্দ্রের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না, তবে শিক্ষকদের কাছ থেকে ইতোমধ্যে তারা যেসব কৌশল শিখেছে সেগুলো তাদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সেসব শিক্ষকদের মধ্যে নাজুম একজন।
হাসতে হাসতে নাজুম বলেন, “১৮ মাস আগে যখন আমি শিক্ষক হয়েছি, তখন থেকে এমন একদিনও যায়নি যেদিন আমি আমার শিক্ষার্থীদের সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার কথা মনে করিয়ে দেইনি।” তিনি আরও বলেন, “এটি তাদের প্রাত্যহিক কাজের অংশে পরিণত হয়েছে।”
নাজুম বলেন, “শিশুরা যেন তাদের নিজেদের হাত পরিষ্কার রাখে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাবান ও পানি ব্যবহার করার কথা বলে সে বিষয়টি আমি শিশুদের নিশ্চিত করতে বলি। শিশুরা এটাও জানে যে, হাত পরিষ্কার রাখলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।”
নাজুম আরও জানান, শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে পালাক্রমে হাত ধোয়া সম্পর্কিত শিক্ষা দেওয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে শিশুদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। নয় বছর বয়সী আশরাফকেও এই ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। আশরাফ এখন হাত ধোয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং বিষয়টিকে সে উপভোগও করে।
আশরাফের বলে, “হাত ধোয়ার বিষয়টি রীতিমতো মজার।” সে আরও বলে, “সঠিকভাবে কিভাবে হাত ধুতে হয় তা আমার শিক্ষক আমাকে শিখিয়েছেন। তাই বিষয়টি এখন আমি অন্যকে শেখাতে পারি।”
একটি সাস্থ্যকর শুরু
শিক্ষাকেন্দ্রগুলো অস্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার অর্থ এই নয় যে, শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ থেমে গেছে। শিক্ষণ নির্দেশিকা, ওয়ার্কবুক এবং অন্যান্য শিক্ষণ উপকরণ সরবরাহ করার মাধ্যমে ইউনিসেফ বাড়িতে পাঠদান করতে শিক্ষক, পিতামাতা এবং সেবাদানকারীদের সহায়তা করছে।
এদিকে, কোভিড-১৯ এর ফলে উদ্ভুত ঝুঁকি কমিয়ে আনতে হাইজিন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রচার সম্পর্কিত কার্যক্রমের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এই রোগের দ্রুত বিস্তার যখন শরণার্থীদের মতো দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে, তখন প্রচলিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং ভাল অনুশীলনগুলো হাত ধোয়ার গুরুত্ব এবং অন্যান্য ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।
নাজুম মনে করেন যে, কোভিড-১৯ এর মতো রোগের বিরুদ্ধে প্রথম সারির প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হলো হাত ধোয়া। ভাষা এবং গণিতের মতো গতানুগতিক স্কুল-বিষয়গুলোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ জীবন দক্ষতা হিসাবে ভাল হাইজিন ও স্বাস্থ্যবিধি একইভাবে শেখানো দরকার।
তার মতে, “অনেক শিশু ভাল স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে আগে খুব বেশি জানত না।” তিনি আরও বলেন, “মায়ানমারে তাদের লেখাপড়ার তেমন কোন সুযোগ ছিল না, এবং এদের কারও কারও স্কুলে কিংবা বাড়িতে সাবানও ছিল না।”
“তারা এখন নিয়মিত তাদের হাত পরিস্কার করতে পারে,”- কথাটির সাথে নাজুম আরও যোগ করেন যে, এটি তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় পার্থক্য তৈরি করেছে।
শিক্ষা কর্মসূচিতে (এডুকেশন প্রোগ্রামে) অবদান রাখার জন্য অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি (কেএফডব্লিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে), জাপান, কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পাশাপাশি গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন, ইউরোপিয়ান সিভিল প্রটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান এইড অপারেশনস (ইকো), এডুকেশন ক্যান নট ওয়েট, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, কিং আব্দুল্লাহ ফাউন্ডেশন, ইউএন সেন্ট্রাল ইমারজেন্সি রেসপন্স ফান্ড (ইউএনসিইআরএফ), ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর দি কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ইউএনওচা) ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রতি ইউনিসেফ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।