সীসাদূষণের বিরুদ্ধে আসমা আক্তারের লড়াই
ইউনিসেফের সহায়তায় একজন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী তার এলাকায় সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে সীসাদূষণ প্রতিরোধে কাজ করে চলেছেন।
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
খড়কুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটি গ্রামীণ সড়ক; সড়কটি ধরে চললে দেখা মেলে বাইমাইল কমিউনিটি ক্লিনিকের। সেখানে, ৩৭ বছর বয়সী একজন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী আসমা আক্তার স্থানীয় নারীদের ১৫ জনের একটি দল নিয়ে আলোচনা করছেন; আর ওই নারীদের ছেলে-মেয়েরা উঠোনে খেলছে।
সীসাদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়ন সীসাদূষণে আক্রান্ত একটি এলাকা। এখানে শিশুদের রক্তের নমুনায় উচ্চ মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অবশ্য আসমাসহ কমিউনিটির অনেকেই সীসার উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। খেলনার মতো সাধারণ জিনিসপত্রের মধ্য দিয়েও এটা শিশুদের শরীরে যেতে পারে সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।
২০২৩ সালের আগস্টে ইউনিসেফ আয়োজিত একটি কর্মশালা থেকে মানবদেহে সীসাদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারেন আসমা। ওই কর্মশালায় আরও ৪৬৮ জন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী অংশ নেন। সীসাদূষণের বিরুদ্ধে আসমার চলমান লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ওই কর্মশালা থেকে প্রাপ্ত তথ্য খুব কাজে দেয়। কর্মশালাটির কথা স্মরণ করে আসমা বলেন, “কর্মশালায় আমি জানতে পারি, কীভাবে শিশুদের খেলনা, সিরামিক পণ্য, রং, রান্নার সরঞ্জাম, প্রসাধনী, এমনকি খাবারের মধ্য দিয়ে মানবদেহে সীসাদূষণ ঘটতে পারে। শিশুরাই সীসাদূষণের বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ তাদের বিকাশমান শরীরে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় সহজে দূষিত পদার্থ প্রবেশ করতে পারে।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে যেসব দেশে সীসাদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় সেই সব দেশের তালিকায় চতুর্থ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। আনুমানিক তিন কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে উচ্চ মাত্রায় সীসার উপস্থিতি রয়েছে। সীসাদূষণের কারণে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়, তাদের মধ্যে রয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা। এ দূষণে তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে অপূরণীয় ক্ষতি এবং তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আনার বিষয়ে মনস্থির করে নিজের কমিউনিটিতে সীসাদূষণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা জোরদারে আত্মনিবেদন করেন আসমা। তিনি নিরলসভাবে নিম্নমানের খেলনায় সীসাদূষণের ঝুঁকির বিষয়ে বাবা-মায়েদের অবগত করছেন এবং এর নিরাপদ বিকল্প বেছে নিতে তাদের উৎসাহিত করছেন। এ বিষয়ে আসমার কার্যক্রম কমিউনিটি ক্লিনিকের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থাকেনি। কীভাবে সীসাদূষণের আসল কারণ মোকাবিলা করা যায় এবং সীসাদূষণের বিপদ সম্পর্কে কমিউনিটিকে সচেতন করে তোলার গুরুত্ব নিয়ে তিনি কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গেও ক্রমাগত আলোচনা করছেন।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আসমা অবশ্য এক বিশেষ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। ঢাকার ৬০ কিলোমিটার উত্তরের এই জনপদে হিন্দু সম্প্রদায়েরও বসতি রয়েছে। হিন্দু বিবাহিত নারীরা কপালে সিঁদুর পরেন। নিম্নমানের সিঁদুরে উচ্চ মাত্রায় সীসাদূষণের ঝুঁকি থাকে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আসমা বলেন, “নিম্নমানের সিঁদুর পরা বন্ধ করার বিষয়ে নারীদের বোঝানোটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। নিরাপদ থাকার জন্য একটু উন্নত মানের সিঁদুর ব্যবহার করার পরামর্শ আমি তাদের দিয়েছিলাম।”
“শিশুদের জন্য ভালো মানের খেলনা এবং নারীদের জন্য ভালো মানের প্রসাধনীর দাম বেশি, যা গ্রামীণ অনেক পরিবারের জন্য যোগানো সম্ভব নয়,” তিনি জানান। এই কঠিন বাস্তবতা সীসাদূষণে ধুঁকতে থাকা কমিউনিটিগুলোর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে, যেখানে নিরাপদ বিকল্পগুলো অনেকের জন্য বিলাসিতা এবং সেগুলো তাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষমতায়ন
কমিউনিটিগুলোকে সচেতন করা এবং সীসাদূষণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে ৬৪৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীকে ব্যাপক পরিসরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ওই প্রশিক্ষণটি পরিচালিত হয়েছিল জাতীয় ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনের আলোকে।
পারস্পারিক অংশগ্রহণমূলক উপস্থাপনা, কেস স্টাডি ও ভিডিও সেশনের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীরা বাংলাদেশে সীসাদূষণের প্রেক্ষাপট ও বিদ্যমান অবস্থা, সীসার উৎস ও তা মানুষের কাছে পৌঁছানোর পথ এবং এর ব্যবস্থপনা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারেন। এই উদ্যোগের ফলে আসমার মতো স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের কমিউনিটিগুলোতে সীসাদূষণ সংক্রান্ত যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেন।
ইউনিসেফের সহায়তা নিয়ে আসমা নিয়মিত তার কমিউনিটিতে সচেতনতা সৃষ্টির সেশন আয়োজন করেন। সেখানে পোস্টার, বুকলেট ও ছবির মাধ্যমে সীসার উৎস, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি উভয়ই কীভাবে সীসাদূষণের শিকার হতে পারে এবং এ থেকে নিরাপদ থাকতে কী কী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে সব বিষয়ে কমিউনিটির সদস্যদের সচেতন করে তোলেন তিনি।
নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে আসমা বলেন, “যখনই কোন পরিচিত মুখ দেখি, তখনই আমি সীসাদূষণ নিয়ে কথা বলি। আমি এখন আমার কমিউনিটিতে এ বিষয়ে পরিবর্তন দেখছি।” নিজের অনেক আত্মীয় ও পরিবারের সদস্যের জীবনযাপন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পেরেছেন জানিয়ে আসমা বলেন, “সবাই, বিশেষ করে শিশুদের ঘন ঘন হাত ধোয়া, খাবারের প্যাকেটগুলো সঠিক জায়গায় ফেলা, উন্নত মানের খেলনা ও প্রসাধনী ব্যবহারের মাধ্যমে সীসাদূষণের প্রভাব ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে।”
সীসামুক্ত ভবিষ্যতের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা
বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ প্রচেষ্টায় আসমার মতো স্বাস্থ্যকর্মীরা সীসাদূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা পাচ্ছেন। তাদের এই লড়াই এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সব শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা। এসব সমন্বিত উদ্যোগগুলো, সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের কার্যক্রমের বিস্তৃতি সম্প্রসারণ ও তা ফলপ্রসূ করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সচতেনতা বৃদ্ধি করছেন এবং সীসাদূষণের ঝুঁকি প্রশমনের কৌশলগুলো বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছেন। দেশে সীসাদূষণের ঝুঁকিমুক্ত একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চলমান উদ্যোগগুলোতে তারা ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন।