সিআরসি ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে শিশুদের উদ্বেগ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অবশ্যই এখনই গ্রহণ করতে হবে
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
সম্প্রতি খুলনায় অনুষ্ঠিত সিআরসি ৩০ ফোরামের আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সাতক্ষীরা জেলার একটি গ্রামের ১৮ বছর বয়সী শাহীন বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলার মানুষদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে তার নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে।
পশ্চিমে সাতক্ষীরা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমানা ঘেঁষে সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে ভাগ করে নিয়েছে। দক্ষিণে, সাতক্ষীরার উপকূলরেখা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
অঞ্চলটি বিশেষত জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শাহীন বলে যে, তার গ্রামে বন্যা একটি অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। তার ভাষায়, “আমাদের বাড়ি-ঘর ও বিদ্যালয়গুলো ভেসে গেছে। আমরা এসব বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।”
একের পর এক বিপর্যয়
তবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় আইলার সাথে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না যা ২০০৯ সালে শাহীনের জীবনকে উল্টে-পাল্টে দিয়েছিলো। তীব্র ঝড়ের সাথে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শাহীন ও তার পরিবারের সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়েছিলো। তার কথায়, “আজ পর্যন্ত আমরা এর ক্ষতি অনুভব করি।”
সে এভাবে বর্ণনা করে, “আমি এবং আমার মা একা বাড়িতে ছিলাম এবং আমরা যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত বাড়িতেই থাকার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের বাড়ি পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছিলো।” এ কারনে, শাহীন এবং তার মা সাঁতরে নিকটবর্তী স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলো। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তারা আশেপাশের পানির পাশাপাশি ব্যাপক বর্ষণের মধ্যে সাহসের সঙ্গে লড়াই করছিলো।
সৌভাগ্যক্রমে, তারা নিরাপদে তাদের আশ্রয়ে পৌঁছাতে এবং দ্রুত শাহীনের বাবাকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিলো। তারা এই কারনে উদ্বিগ্ন ছিল যে, শাহীনের বাবা ঐদিন কিছুক্ষণ আগে তাঁদের পরিবারের কিছু জিনিষপত্র আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং এরপর থেকে শাহীন কিংবা তার মা, শাহীনের বাবার কোনো খোঁজ পায় নি।
শাহীনের প্রথম সপ্তাহে আশ্রয়কেন্দ্রের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। “সেখানে পরিমাণমতো কোনো খাদ্য বা পানীয় ছিলো না। এবং, সেখানে মারাত্মক ডাইরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিলো”। এর ফলে, শাহীনের এক পারিবারিক বন্ধু মারা গিয়েছিলো।
শাহীনের অনুমাণ, তার পরিবার প্রায় এক মাস আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করেছিলো। এখানে শাহীনের পরিবারকে একটি বড় কক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ জনের সাথে থাকতে হতো। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে আসার পর, “আমি দেড় বছর স্কুলে যেতে পারি নি।” শাহীন আরো বলে, “কারন, যে সব মানুষ নতুন করে তাদের বাড়িঘর তৈরি করতে পারেনি, সেসব মানুষের জন্য বিদ্যালয়টিকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো।”
মাত্র কয়েক মাস আগে, অর্থাৎ মার্চ ২০১৯-এ, শাহীনের জীবনে আরেকটি দুঃস্বপ্ন এসেছিলো। ঘূর্ণিঝড় ফণী বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছেছিলো এবং শাহীনের জীবনকে আরো একবার উপড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো। শাহীনের ভাষায়, “আমি এতটা ভীত হয়ে গিয়েছিলাম যে, একই ঘটনা আবারো ঘটতে চলেছে।”
কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে শাহীন এবং তার সম্প্রদায়ের মানুষ আরো বেশি স্থিতিশীল হয়েছে। শাহীন বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছে যে, “আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি এবং এ কারনেই আমরা ঘূর্ণিঝড় ফণীর বিষয়ে প্রস্তুত ছিলাম। আমরা অতি দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলাম এবং সুরক্ষিত ছিলাম।”
শাহীন আরো যোগ করে যে, “আমি শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছি। তিনি বলেন, “আমি আমার পরিবারকে আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে এবং নিরাপদে অবস্থান করতে রাজী করিয়েছি।” এরপরেও, শাহীনের এলাকার লোকদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদের গ্রামের মাছের ডিম সংগ্রহকারীরা জীবিকা-নির্বাহের পথ হারিয়েছে।
ইউনিসেফের সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের শিশু সাংবাদিক এবং মেধাবী ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার শাহীন বলে, “আমি আমার গ্রামের মানুষের কষ্ট দেখেছি এবং আমি তাদের গল্প বলতে চেয়েছি।” তার ক্যামেরায় সে এসব ঘটনাকে তুলে এনেছিল এবং তার কাজগুলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শেয়ার করতো।
তথ্য ছড়িয়ে দেবার এই উপলব্ধিবোধ তাকে সিআরসি ৩০ ফোরামে অংশ নিতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো: “তাদের [গ্রামবাসীর] উদ্বেগের বিষয়গুলো আমার তুলে ধরা দরকার।”
শিশুদের কণ্ঠস্বর বলিষ্ঠ করার সুযোগ
শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ৩০ তম বার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ বিতর্ক ফেডারেশানের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউনিসেফ বাংলাদেশ তরুণদের শক্তিকে ব্যবহার করেছিলো এবং একইসাথে শিশু অধিকার নিয়ে দেশব্যাপী সংলাপের জন্য সিআরসি ৩০ ফোরাম চালু করেছিলো।
সারা দেশের তরুণরা সিআরসি ৩০ ফোরামে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশের শিশু অধিকারের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে শিশু অধিকারকে আরো সুরক্ষিত রাখার উপায় নিয়ে আলোচনা করতে এই ফোরামে বিশেষজ্ঞ, নীতি নির্ধারক এবং সামাজিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে এমন লোকেরা এতে অংশ নিয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাল্যবিবাহ থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ে সহিংসতা ও তরুণদের কর্মসংস্থান এবং সংখ্যালঘু অধিকারসহ বাংলাদেশে শিশু অধিকারের জন্য হুমকি হতে পারে এমন বেশ কিছু বিষয় নিয়ে এই ফোরামে আলোচনা করা হয়েছিলো।
এই ফোরামে অংশগ্রহণকারী তরুণরা অবশ্য এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে কথা বলার বাইরেও আরো অনেক কিছু করেছিলো। তারা এসব সমস্যাগুলো সমাধানেরও চেষ্টা করেছিলো। কার্যকরভারে সমস্যাগুলো সমাধান করা এবং শিশুর অধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নীতিগত সুপারিশমালা প্রনয়নে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কাজ করেছিলো। এরপর তাদের উপস্থিতিতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নিকট তারা সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছিলো। শাহীন ও তাঁর দলের সদস্যরা স্থানীয় নীতি নির্ধারক, আমলা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছিল এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান চেয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই একটি অগ্রাধিকার
জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ে শাহীনের গ্রাম সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হয়েছিলো। উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত শিশুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন একটি হুমকিস্বরূপ। এসব অধিকারের মধ্যে শিক্ষা ও পুষ্টির অধিকার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার অধিকার রয়েছে।
সিআরসি ৩০ ফোরামের আলোচনায় শাহীন ও তার দল একটি বিষয় পরিস্কার করে এবং সে বিষয়টি হলো: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অবশ্যই এখনই গ্রহণ করতে হবে।