সামাজিক দূরত্বের ফলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে
কোভিড-১৯-এর সময়ে শিশুরা টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনে বেশি সময় দিচ্ছে যা তাদের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের ১৬ বছর বয়সী ইরার (তার প্রকৃত নাম নয়) অনলাইনে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হয়। প্রথমে তারা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করত। পরে তারা ভয়েস মেসেজ বিনিময় করার পাশাপাশি ফোনেও কথা বলা শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইরা ছেলেটির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তবে, ছেলেটির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরা তেমন কিছুই জানত না।
দু’জন আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে ছেলেটি তাদের অন্তরঙ্গ ছবিগুলো শেয়ার করার জন্য ইরা’কে বারবার অনুরোধ করত। প্রথম দিকে ইরা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে কিন্তু পরবর্তী সময়ে ছেলেটির বার বার অনুরোধে ইরা কিছুটা নমনীয় হয়। অনুরোধে সাড়া দেওয়ার সাথে সাথে ছেলেটির মনোভাব রাতারাতি বদলে যায়। ইরা যদি ছেলেটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক না রাখে তবে ছেলেটি ছবিগুলো অনলাইনে প্রকাশ করবে বলে এবার ইরা’কে হুমকি দেওয়া শুরু করে। ইরা’কে ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ছেলেটি প্রথমে এক হাজার টাকা (১২ মার্কিন ডলার) নেয় এবং পরে তাকে আরও ৪,০০০ টাকা (৪৮ ডলার) না দিলে ইরা’র ছবিগুলো প্রকাশের হুমকি দেয়।
পরিবারের জন্য বড় ধরনের লজ্জা এবং ভয়ঙ্কর সামাজিক পরিণতির ভয়ভিতি থেকে ইরা আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, সাহায্য পাবার জন্য মরিয়া হয়ে ইরা প্রথমে ইউনিসেফের সহায়তা ও সমাজসেবা বিভাগের অধীনে পরিচালিত শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮-এ ফোন করে।
লুকিয়ে থাকা অনলাইন সুযোগ-সন্ধানী
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলে বলেন, “লকডাউন চলাকালীন শিশুদের টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করার পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি শিশুদের জন্য ঝুঁকিও বেড়েছে। তারা ক্ষতিকর বিষয়বস্তু এবং অনলাইন সুযোগ-সন্ধানীর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে সমাজসেবা বিভাগের অধীনে ইউনিসেফের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ হলো শিশু হেল্পলাইন এবং এই হেল্পলাইন অনেক শিশু এবং তরুণের জন্য একটি লাইফলাইন হিসাবে কাজ করে।”
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে এমন প্রায় ৭০ জন কিশোর-কিশোরীকে শিশু হেল্পলাইনে মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ প্রদান করা হয়, যাদের বেশিরভাগই মেয়ে।
কোভিড-১৯ এর বিধিনিষেধ চলাকালীন অনেক কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হয়। অনলাইনে বেশি বেশি সময় ব্যয় করায় এদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষতিকারক ভার্চুয়াল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮-এর ব্যবস্থাপক চৌধুরী মোঃ মোহাইমেন বলেন, “মহামারী চলাকালীন আত্মহত্যা বেড়েছে কিনা তা আমরা বলতে পারি না। বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল এমন অনেক কিশোর-কিশোরীর কাছ থেকে এর আগেও আমরা ফোনকল পেয়েছি। এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি সাইবার অপরাধ, অনলাইন সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতকতা এবং পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীদের সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত”।
মোহাইমেন আরও বলেন, “স্কুল এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি খোলা থাকত তবে এই পর্যায়ের ভার্চুয়াল নির্ভরতা সম্ভবত এড়ানো যেত।”
অনলাইন সুরক্ষা – বিপদসংকেত শোনা যাচ্ছে
অনলাইনে সংঘটিত হয়েছে এমন অনেক বিপদ সম্পর্কে ২০১৯ সালে ইউনিসেফ পরিচালিত একটি অনলাইন সমীক্ষায় সতর্ক করা হয়েছে। সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু সাইবার বুলিং এবং ডিজিটাল হয়রানির শিকার হচ্ছে।
এরই ফলশ্রুতিতে, অনলাইনে সহিংসতা প্রতিরোধ এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা ক্রমশ যেসব ঝুঁকির সন্মুখিন হচ্ছে সেগুলো কমাতে অনলাইন সুরক্ষা বিষয়ে শিশুদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কোর্স যৌথভাবে তৈরি করেছে ইউনিসেফ এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
২০২১ সালের মধ্যে ১০ লক্ষ স্কুল শিশুকে অনলাইন সুরক্ষা সংক্রান্ত সনদপত্র প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ পর্যন্ত দুই লক্ষ ৮০ হাজার শিশু এই অনলাইন কোর্সে অংশ নিয়েছে এবং সনদপত্র পেয়েছে।
অন্য একটি কার্যক্রমের অধীনে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে আড়াই লক্ষ শিক্ষার্থী ও কিশোর-কিশোরীর মধ্যে অনলাইন সুরক্ষা বিষয়ে প্রচারের জন্য ইউনিসেফ টেলিযোগাযোগ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে। এছাড়াও, ওয়েবিনার এবং একটি জাতীয় যোগাযোগ প্রচারণার মাধ্যমে দুই লক্ষ পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষককে সচেতন করা হয়েছে।
কোভিড-১৯ এর সময় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে ইউনিসেফ মনো-সামাজিক পরামর্শ প্রদান কার্যক্রম জোরদার করেছে। এসময় দূরবর্তী সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে ইউনিসেফ প্রায় দুই লক্ষ শিশু এবং তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছেছে।
নিরাপদ ইন্টারনেট এখন আশু প্রয়োজন
ইরা যদি শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮-এ যোগাযোগ না করত, তবে সে আজ হয়তো বেঁচে থাকতে পারত না। হেল্পলাইন কর্মীরা ইরা’কে পরামর্শ দিয়েছে এবং আশ্বস্ত করেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে বার বার তার সাথে কথা বলে তারা ইরা’র উদ্বেগ এবং আত্মঘাতী চিন্তাভাবনাকে দূর করতে পেরেছিল এবং অপরাধী বিচারের মুখোমুখি হবে এমনটা আশ্বাস দিয়েছিল।
হেল্পলাইন কর্মীরা ইরা’র বড় বোনের সহযোগিতা চায় এবং তাকে স্থানীয় থানায় ছেলেটির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করতে সহযোগিতা করে।
এর পরপরই, শিশু হেল্পলাইন মোবাইল টিম, স্থানীয় পুলিশ এবং সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সহায়তায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মহামারীটি এখনও অব্যাহত এবং স্কুলগুলো বন্ধ থাকায়, শিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ নিরাপদ অনলাইন কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বিষয়ক দক্ষতার মাধ্যমে শিশুরা ডিজিটাল যোগাযোগের ইতিবাচক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে এবং সহিংসতা, হুমকি এবং নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে একে অপরের সাথে সংযুক্ত হতে পারে।
শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে সহযোগিতার জন্য গ্রামীণফোন, টেলিনর ও ইউনিসেফ নরওয়ে এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতি ইউনিসেফ বাংলাদেশ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।