শিশু মাহদির জন্য লড়াইয়ের একটি সুযোগ
বাংলাদেশে দারিদ্র্য, বন্যা ও অপুষ্টির মাঝে টিকে থাকা
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রক্তি নদীর তীরে একটি গ্রামে জন্মগ্রহণের বেশ আগে থেকেই শিশু মাহদির সমস্যা শুরু। মাহদির মা ইসমত আরা বেড়ে উঠেছেন একটি দরিদ্র পরিবারে। তার ভাগ্য যেন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। অল্প বয়সেই বাবা-মা স্কুল থেকে ছাড়িয়ে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন।
শিশু মাহদির পরিবার তার বাবা মোহাম্মদ কাওসারের দৈনিক মজুরির উপর নির্ভরশীল। যখন, যেখানে কাজ মেলে, সেখানেই কাজে লেগে পড়েন কাওসার। ফসল কাটার মৌসুমে ধান ক্ষেতে, কিংবা যেখানে নির্মাণ কাজ চলছে অথবা বালি উত্তোলনের জায়গায় প্রতিদিন কাজের সন্ধানে তিনি ঘুরে বেড়ান । ভাগ্য ভালো হলে, দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা (২ থেকে ৩ ডলার) আয় হয় নতুবা খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হয় তাকে।
যেদিন কাজ মেলে না, সেদিন ছোট্ট এই পরিবারটিকে উপোস থাকতে হয়। আর কাজ মিললেও বেশিরভাগ দিনই ভাত ও শাক-সবজির বেশি জোটে না। মাছ, মাংস ও ডিমের মতো আমিষ জাতীয় খাবার খুব কম সময়ই কিনতে পারেন মোহাম্মদ কাওসার।
এ যেন এক নিষ্ঠুর চক্র
মাহদির মা মাত্র ১৮ বছর বয়সেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। সামান্য উপার্জন দিয়ে পরিবারটি তখন টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রায় ক্লান্ত। গর্ভকালীন সময়ের বাড়তি যত্ন ছিল যেন এক ধরনের বিলাসিতা। তাই জন্মের পর থেকেই মাহদির স্বাস্থ্য ছিল বেশ নাজুক।
“আমার বুকের দুধ পর্যাপ্ত পরিমানে হচ্ছিল না। মাহদি অনেক কান্নাকাটি করতো এবং প্রায়ই অসুস্থ থাকতো। আমরা জানতাম যে সে পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না, কিন্তু আমরা অসহায় ছিলাম,”- ইসমত আরা বলেন।
মাহদির জন্মের কয়েক মাস পর তাদের গ্রামে বন্যা হয়। শেষ সম্বলটুকুও চোখের সামনে বন্যায় বিলীন হতে দেখে পরিবারটি। সন্তানকে আকড়ে ধরে, হাতের কাছে যা কিছু ছিল তাই দিয়ে একটি মই বানিয়ে ঘরের চালে আশ্রয় নেন মোহাম্মদ কাওসার ও ইসমত আরা। শুরু হয় অপেক্ষা।
এক সপ্তাহ পর বন্যার পানি নেমে যায় কিন্তু ততদিনে মাহদি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, সে আর কাঁদতেও পারছিল না!
“বন্যার পর কাজ খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা কীভাবে দিন পার করেছি তা একমাত্র আল্লাহই জানেন,”- বলেন মোহাম্মদ কাওসার।
এদিকে দিন দিন মাহদির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে । সিলেটে বন্যা পরবর্তী জরুরী সহায়তার অংশ হিসেবে ইউনিসেফ মাহদির গ্রামে তার কার্যক্রম শুরু করে । এই কার্যক্রমের আওতায় মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পুষ্টির অবস্থা মূল্যায়ন করেন। এমনি এক পরিদর্শনের সময় মাহদির মারাত্মক অপুষ্টি ধরা পড়ে। মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী মাহদির বাবা-মাকে জানান যে মারাত্মক অপুষ্টির জন্য তার জরুরী ভিত্তিতে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন।
মোহাম্মদ কাওসার ও ইসমত আরা রওনা হন তাহিরপুর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে; কাদামাখা রাস্তা পাড়ি দিয়ে,নৌকায় করে অবশেষে তারা হাসপাতালে পৌছান। হাসপাতালে মাহদির মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিতে ভোগার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তাকে এফ-৭৫ ও এফ-১০০ নামক থেরাপিউটিক দুধ খাওয়ানো হয়, যা মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। এটি অপুষ্ট শিশুদের খাবারের রুচি ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ সরকার ইউনিসেফের সহযোগিতায় মাহদির মত অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সহায়তা সামগ্রী সরবরাহ করে থাকে। এফ-৭৫ ও এফ-১০০ থেরাপিউটিক দুধ সেই সহায়তার অত্যাবশ্যকীয় অংশ।
জীবন বাঁচানোর প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশের লাখ লাখ শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না এবং এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যা শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যহত করতে পারে, যা 'স্টান্টিং' বা খর্বাকৃতি (বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা) নামে পরিচিত।
‘স্টান্টিংয়ের ‘ কারণে একটি শিশুর শরীর ও মস্তিষ্কের যে ক্ষতি হয় তা ফেরানো যায় না। এটি শুরুতে স্কুলে, পরে কর্মক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয় এবং শিশুকে সংক্রামক রোগে মারা যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলে। এখন একদিকে যেমন শৈশবে স্টান্টিংয়ে আক্রান্ত হওয়া প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এর ক্ষতিকর বোঝা বয়ে চলেছে, অন্যদিকে প্রায় 88 লাখ নতুন শিশু ‘স্টান্টিংয়ে’ আক্রান্ত হচ্ছে ।
অপর্যাপ্ত খাবারের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর খাবারও গুরুতর রুগ্নতা, (উচ্চতার তুলনায় কম ওজন) বা কৃশকায় হয়ে পড়ার কারণ হতে পারে। প্রায় ৪ লাখ শিশু এই মুহূর্তে ‘ওয়েস্টিং’বা কৃশকায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত । যদি সময়মত চিকিৎসা করা না হয়, এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
যদিও কয়েক বছর ধরে দেশে খর্বাকায় এবং কৃশকায় হয়ে পড়ার হার কমেছে, তবে অপুষ্টিতে ভোগার সমস্যা নির্মূল করতে আরও কঠোর পদক্ষেপ দরকার।
মাহদির মতো শিশু, যারা দরিদ্রতম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং যারা মায়েদের পুষ্টি ও পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে কম জানেন, তাদের খর্বাকায় ও কৃশকায় -এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বন্যার মতো দুর্যোগ এলে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় কমিউনিটি পর্যায়ে প্রাথমিক অবস্থায় অপুষ্টি শনাক্ত করার জন্য নিয়মিত শিশুর অবস্থা মূল্যায়ন করার কোনো পদ্ধতি এই মূহুর্তে নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ ও সমস্যা শনাক্তকরণ বা স্ক্রিনিং সেবা শুধু জরুরি পরিস্থিতিতে প্রদান করা হয়, বিশেষ করে যখন কমিউনিটিগুলো স্বাস্থ্য সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিয়মিত সেবা নিতে পারে না।
“প্রতিরোধ ছাড়াও অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের জন্য জীবনরক্ষাকারী থেরাপিউটিক দুধ ও ওষুধ যাতে পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে পার্টনারদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে কাজ করে ইউনিসেফ। শিশুরা যাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায় তা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যা শনাক্তকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,”- বলেন কাজী দিল আফরোজা ইসলাম। তিনি সিলেট ইউনিসেফের ফিল্ড অফিস পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন।
দ্বিতীয় সুযোগ
আজ শিশু মাহদি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং তার ওজন বেড়েছে।
"আমরা এই বিশেষ দুধ সম্পর্কে জানতাম না। আমাদের ছেলেকে আবার হাসতে দেখতে পারাটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ,"- বলেন মোহাম্মদ কাওসার।
কিন্তু ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। কারন, তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটলে থেরাপিউটিক দুধ বন্ধ করে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার উপর জোর দেয়া হয়। তাই কাওসার উদ্বিগ্ন যে তার ছেলে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়বে, কারণ নয় মাস বয়সী মাহদির জন্য এখন প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাবারের প্রয়োজন। আর দিন দিন খাবারের দাম বেড়েই চলেছে।
মোহাম্মদ কাওসার বলেন, “সবকিছুর দাম এখন বেশি। আগে এক কেজি চাল পেতাম ৫০ টাকায় (প্রায় আধ ডলার)। এখন এর দামও বেড়েছে। ফলে আমি যতটুকু কিনতে পারি তা দিয়ে আমাদের প্রয়োজন মেটে না।”
প্রতিদিন মোহাম্মদ কাওসার কাজের খোঁজে বের হয়। আর ইসমত আরা বাড়িতে থেকে শিশু মাহদির যত্ন নেন। কাজ পেলে খাবার জুটবে, নইলে সবার উপোস থাকতে হবে।
"আমার ছেলে আমাদের জীবনের আলো,"- বলেন মোহাম্মদ কাওসার।