শিশুদের উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে জাতীয় বাজেটের সামাজিক খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার
প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ শনাক্তকরণ ও উত্তরণে ইউনিসেফের উদ্যোগ
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পাস হয়। অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর অভিঘাত কাটিয়ে ওঠা এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, সে সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক খাত ও শিশুর কল্যাণে বিনিয়োগের জন্য জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বাজেটে কতটা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার একটি পর্যালোচনা বেশ জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ইউনিসেফ সরকারি কর্মকর্তা, দাতা, উন্নয়ন অংশীজন (পার্টনার), সুশীল সমাজ সংগঠন (সিএসও) ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোর (আইএনজিও) প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক খাতে বরাদ্দ: বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম’ শিরোনামে একটি উচ্চ পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। ‘সেখানে বক্তারা এ বিষয়ে তাদের ভাবনাগুলো তুলে ধরেন এবং বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতির উন্নয়নে নানারকম পরামর্শ দেন। বাজেটে সামাজিক খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহারের উপায় নিয়েও তারা কথা বলেন।
বাজেট ব্যবহারের প্রবণতা বিশ্লেষণ
বৈঠকে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে গত পাঁচ বছরে বাজেট বাস্তবায়নের প্রবণতা বিষয়ক একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। আলোচকেরা সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করেন। ইউনিসেফের বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশ কিছু পদ্ধতিগত কারণে সামাজিক খাতে বরাদ্দকৃত প্রকৃত বাজেটের ১৫ শতাংশেরও বেশি অব্যবহৃত থেকে যায়।
দেখা গেছে, বাজেট ব্যবহারের দিক দিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাদ্দের প্রায় পুরোটাই ব্যবহার করছে। আবার একই সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও এই মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশে মাতৃ মৃত্যু ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতেও উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু অর্জন রয়েছে। যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তির হার প্রায় একশ ভাগে পৌঁছেছে। এখানে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। অবশ্য অর্থবছরের শেষ দিকে বাজেট বরাদ্দ কাজে খাটানোর জন্য যে তাড়াহুড়ো শুরু হয়, তাতে প্রকল্পের মানসম্মত বাস্তবায়ন নিয়ে ঝুঁকি থেকে যায়। গত পাঁচ বছরের ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক ব্যয় হয়েছে অর্থবছরের শেষ অর্থাৎ চতুর্থ প্রান্তিকে। তার মধ্যে শেষ মাসে ব্যয় হয়েছে পুরো ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থ।
বরাদ্দকৃত বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেসরকারি খাত-সামাজিক সুরক্ষা ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে রূপান্তর বিষয়ক প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইশরাত শবনম বলেন যে শুধু শিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখাটাই যথেষ্ট নয়। শিশুদের জন্য মানসম্মত পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং বাজেট বাস্তবায়ন মনিটরিঙয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারও গত কয়েক বছর ধরে সময়মত ও কার্যকরীভাবে বাজেট বাস্তবায়ন জোরদার করার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বাজেট বাস্তবায়নের হার কম হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প প্রণয়ন ধাপে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ যেমন পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ না করে প্রকল্প গ্রহণ, অযৌক্তিক বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে যথাযথ মূল্যায়নের ঘাটতি। এরপর বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তার বদলি, অনুমোদন পেতে সময়ক্ষেপণ এবং অবকাঠামো তৈরিতে জমি অধিগ্রহণের জন্য বিলম্বের মতো বিষয়েরও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব দিলরুবা শাহীনা বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে প্রয়োজনীয় দক্ষতার ও বিশেষায়িত জ্ঞানের ঘাটতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
বাজেট সদ্ব্যবহারের উপায়
এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে, আলোচনা থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নে সমন্বিত অ্যাপ্রোচ, কার্যকর প্রকল্প মনিটরিং (পরিবীক্ষণ) টুল এবং তহবিল ছাড়ের প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আনা। কার্যকরভাবে সরকারি অর্থ ব্যয় নিশ্চিত করার জন্য এগুলো সবই জরুরি। এটা করা গেলে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ।
গোলটেবিল বৈঠকের সমাপনী বক্তব্যে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট পুনরায় আশ্বস্ত করে বলেন, “পরিকল্পনা, মনিটরিং এবং সমন্বয় প্রক্রিয়াকে জোরদার করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করতে ইউনিসেফ ও এর অংশীজনেরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শিশুদের কল্যাণে সঠিক সময়ে সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এই সভার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে ইউনিসেফ।