“রাস্তায় মানুষ আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করতো তাতে আমি ভয় পেতাম”
যেসব শিশু রাস্তায় বসবাস ও কাজ করে তাদের সহানুভূতি ও সহায়তা প্রয়োজন

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
হাসিব তার সঠিক বয়স জানে না। তবে আনুমানিক,, তার বয়স এখন ১২ হওয়া উচিত। মাত্র ৭ বছর বয়সে সে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তার গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। শৈশবের শুরুর দিকের কথা হাসিবের খুব একটা মনে নেই,! তবে একটি উন্নত জীবনের সন্ধানে বাড়ি ছাড়ার সময় তার কতটা দুঃখ ও রাগ হয়েছিল সেটি ঠিকই মনে আছে।
হাসিবের বাবা তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনার কিছুদিন পর হাসিব ও তার মা তার চাচার বাড়িতে থাকার জায়গা হারায়।

“আমি যখন আমার মায়ের সঙ্গে প্রথম ঢাকায় আসি, তখন আমরা বাসস্ট্যান্ডে থাকতাম। মাঝে মাঝে আন্ডারপাসে ঘুমাতাম। ওই সময় লোকজনের আচরণে আমি খুব কষ্ট পেতাম। আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করলে তারা আমাদের দিকে পানি ছুড়ে মারত। তারা আমাদের অপমানজনক নামে ডাকত,” বলে হাসিব।
পরিবার চালাতে বাধ্য
বেশ কয়েক বছর মা হাসিনার সঙ্গে রাস্তায় থাকে হাসিব। ছোট বোন মিমের জন্মের পর তার দায়িত্ব বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে তারা বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো। ‘কিন্তু আমরা যখন ভাড়া দিতে পারতাম না, তখন তারা আমাদের বের করে দিত,’ বলে হাসিব।
হাসিব এখন বাস টার্মিনাল দিয়ে যাতায়াতকারীদের কাছে বই ও চকলেট বিক্রি করে। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা (আনুমানিক ২ ডলার) উপার্জন হয় এবং এভাবেই সে তার মা ও ছোট বোনের দেখাশোনা করে।
কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যেসব শিশুর তাদের জন্য একটি আশ্রয়
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলি বলেন, “যদিও আমরা বাংলাদেশে রাস্তা-ঘাটে বসবাসকারী শিশুদের সঠিক সংখ্যা জানি না, তবে যেসব শিশু রাত-দিনের বেশিরভাগ সময় রাস্তায় কাটায়, তা যদি একজনও হয় সেটাও অনেক বেশি। এই শিশুরা জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের ঘুমানোর জন্য একটি বিছানা নেই। নিজের নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন একটি ঘরও তাদের নেই।”
বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউনিসেফ ঢাকায় তিনটি শিশু সুরক্ষা সেবাকেন্দ্র পরিচালনা করছে। কেন্দ্রগুলোতে সমাজকর্মীরা রাস্তায় থাকা শিশুদের সেবা দেন। বিশেষ করে, যেসব শিশু তাদের বেশির ভাগ সময় অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ পরিস্থিতিতে কাটায় এবং যারা প্রতিদিন অবহেলা, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয় তাদের কাছে ওই সেবা পৌঁছে দেন। সমাজকর্মীরা শিশুদেরকে তাদের পরিবারের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত করা, তাদের স্কুলে ভর্তি করা এবং রাস্তায় তারা যেসব ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন। একই সময়ে সেবাকেন্দ্রে শিশুরা বিনামূল্যে খাবার, বিশ্রামের জায়গা, কাউন্সেলিং এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা ও শেখার সুযোগ পাচ্ছে।
স্কুলে ফিরে যাওয়া এবং থাকার একটি জায়গা
মা-বোনের ভরণ-পোষণের চাপ কখনও কখনও হাসিবের ওপর খুব বেশি হয়ে যেত। প্রথম যখন সে ওই সেবাকেন্দ্রে আসে তখন কেন্দ্রের সমাজকর্মী মাকসুদা তাকে ও তার মাকে অনেক পরামর্শ দেন। এতে হাসিবের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হয়। হাসিব যখন সেবাকেন্দ্রে যেত এবং মাঝে মাঝে সেখানে রাত্রিযাপন করতো, তখন মাকসুদা তার মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন।
হাসিবের মাকে একটি জন্মসনদ সংগ্রহ করতে এবং টার্মিনালে একটি চাকরি পেতে সাহায্য করেন সমাজকর্মী মাকসুদা। যদিও হাসিবের মায়ের সেই চাকরি এখন আর নেই, তবে তিনি পাশের বস্তিতে একটি ঘর ভাড়া নিতে পেরেছিলেন। আর মাকসুদার প্রচেষ্টায় হাসিবকে এ বছর এলাকার অসহায় শিশুদের জন্য চালু করা একটি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
“আমি এখন সপ্তাহে পাঁচ দিন স্কুলে যাই, ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সেখানে থাকি। তারা আমাকে সবকিছু শেখায়। আমি সেবাকেন্দ্রে আসি এবং পরে তা অনুশীলন করি,” গর্বের সঙ্গে বলে হাসিব।
তার পরিবারকে সহায়তা করার জন্য এখনও হাসিবকে কাজ করতে হয়। তবে তার অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। যখন সে সময় পায় এবং হাতে অল্প স্বল্প টাকা থাকে, তখন সে স্থানীয় একটি কম্পিউটারের দোকানে গান শুনতে যায়, যে গানটি পরে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে গাইতে পছন্দ করে।
শিশুদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছেন সমাজকর্মীরা

হাসিবের জীবনের এই গল্প দেখায় যে, কীভাবে একজন দক্ষ ও অনুপ্রাণিত সমাজকর্মী একজন শিশুর জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারেন। তবুও বাংলাদেশের মতন ১৭ কোটি মানুষের একটা দেশে শিশু সুরক্ষার জন্য সমাজকর্মী মাত্র ১৮১ জন। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ দেশের সমাজসেবা কর্মী বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছে। প্রতিটি গ্রাম ও কমিউনিটিতে যেন একজন সমাজকর্মী থাকেন, যিনি হাসিবের মতো শিশুদের যে পরিস্থিতি ‘পথশিশুর’ জীবনে ঠেলে দেয় সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিতে পারবেন- এই লক্ষ্যে ইউনিসেফ দেশের সমাজসেবা কর্মী বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ।
হাসিব বলে, “রাস্তায় মানুষ আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করতো তাতে আমি ভয় পেতাম।’’
বছরের পর বছর ঢাকার রাস্তায় প্রথমদিকের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো কাটিয়ে হাসিব দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। সে স্কুলে ফিরেছে, যখন সে বন্ধুদের সঙ্গে গান গায় তখন দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত হয় এবং আবার স্বপ্ন দেখার সাহস করে।
হাসিব বলে, " আমি পড়াশুনা শেষ করতে চাই। আমার জীবনে একটা স্বপ্ন আছে- বড় হয়ে আমি আমার মায়ের জন্য একটি ঘর বানাতে চাই।"