মেয়েদের স্থান ক্লাসরুমে: রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা

স্কুলে রোহিঙ্গা কিশোরীর সংখ্যা বাড়াতে গুণগতমান ও সমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে

ইউনিসেফ
Girls attending go-only sessions for Rohingya refugee girls in UNICEF learning centres
UNICEF/UN0690296/Spiridonova
22 আগস্ট 2022

বাংলাদেশে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নিজের সন্তানদের সুরক্ষায় রহিমা আক্তার* সবকিছু করতে রাজি। অস্থায়ী এই শিবিরে তারা অপরিচিত লোকজনদের সঙ্গে গাদাগাদি করে বসবাস করে। রহিমা বিশেষ করে তার মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। একসময় তিনি মনে করতেন, ১৪ বছর বয়সী নুরকোলিমাকে* স্কুলে পাঠানোর চেয়ে বাড়িতে রাখাই নিরাপদ। কারণ স্কুলে যেতে দেওয়া হলে সেখানে তার ওপর পুরুষদের কুদৃষ্টি পড়তে পারে। নুরকোলিমাকে নিরাপদে রাখতে যদি তার লেখাপড়া বাদ দিতে হয়, তবে তাই হোক।

মিয়ানমারে থাকাকালে যৌন হয়রানির শিকার হন রহিমা। তার বাবা-মা যখন ওই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তারা এটিকে বড় ধরনের কেলেঙ্কারী মনে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বিয়ে দিয়ে দেন। সেই স্মৃতি, অপমান, সব কিছুই তাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।

“যখন একটি মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে, তখন তাকে বাইরে যেতে দেওয়া উচিত নয়। ছেলে এবং মেয়েদের একই শ্রেণিকক্ষে সময় কাটানোও ঠিক নয়। কারণ এটি তাদের খারাপ কিছুর দিকে নিয়ে যেতে পারে।’’ আশ্রয় শিবিরে বহু বাবা-মায়ের মাঝে এখনও বিদ্যমান এ ভুল ধারণাগুলো তুলে ধরে রহিমা।    

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ৪ লাখেরও বেশি স্কুল-বয়সী শিশুর বসবাস, যাদের অর্ধেকই মেয়ে। তাদের সার্বিক মঙ্গল ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার জন্য পড়াশোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও মেয়েরা প্রায়শই ছেলেদের তুলনায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশি বাধার সম্মুখীন। এর পেছনে রয়েছে প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা, যা তাদের বাড়ির বাইরে সময় কাটানো এবং কারও সঙ্গে মেলামেশাকে সীমিত করে।

যে কারণে ইউনিসেফ ও সহযোগীরা রহিমার মতো বাবা-মায়েদের তাদের কিশোরী কন্যাদের স্কুলে পাঠানোর দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা সম্পর্কে বোঝাতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।

ইউনিসেফ শিক্ষাকেন্দ্রে হাত-তালি দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করা সহপাঠীদের উৎসাহ দিচ্ছে কিশোরীরা।
UNICEF/UN0690297/Spiridonova
ইউনিসেফ শিক্ষাকেন্দ্রে হাত-তালি দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করা সহপাঠীদের উৎসাহ দিচ্ছে কিশোরীরা।

রোহিঙ্গা শরণার্থী মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাধা

ক্যাম্পজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৩,৪০০টি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২,৮০০টি কেন্দ্র ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত। শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ইংরেজি, বার্মিজ, গণিত, বিজ্ঞান ও বিভিন্ন জীবন দক্ষতা বিষয়ে শেখানো হয়, এবং এগুলোর চাহিদাও অনেক। ৬ থেকে ১১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশুদের ৮০ শতাংশ এখন শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি রয়েছে। শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তির হার ছেলে-মেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই বেশি।

কিন্তু উপাত্ত বলছে, মেয়েদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক্ষেত্রে লিঙ্গ ব্যবধান প্রকট হয়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিকালে পোঁছানোর পর – সাধারণত ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সে – উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।

সহযোগীদের সাথে মিলে ইউনিসেফ সম্প্রতি ঘরে-ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষা কেন্দ্রে যেতে বাধার কারণগুলো বোঝার জন্য রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে।

বার্মিজ ভাষা লেখার চর্চা করছে একটি মেয়ে, যা মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের শেখা পাঁচটি বিষয়ের একটি।
UNICEF/UN0690299/Spiridonova
বার্মিজ ভাষা লেখার চর্চা করছে একটি মেয়ে, যা মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের শেখা পাঁচটি বিষয়ের একটি।

বাবা-মায়েরা বলেন, কিশোরী মেয়েদের শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো সাংস্কৃতিকভাবে ঠিক নয়। তারা বিশ্বাস করেন, মেয়েদের শেখার বয়স বহু আগেই পার হয়ে গিয়েছে এবং জনসমাগমে ছেলেদের সঙ্গে তাদের মেলামেশা করা উচিত নয়।

তাছাড়া, অনেক বাবা-মা মনে করেন মেয়েদের লেখাপড়া করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। বিয়ে ও নিজের পরিবার হওয়ার আগে তারা বাড়িতে মাকে কাজে সাহায্য করবে । অন্যদিকে, জীবিকা অর্জনের জন্য বাইরের বিশ্বে বেরিয়ে যেতে ছেলেদের উৎসাহিত করা হয়।

নিজের কমিউনিটিতে এখনও বিদ্যমান লিঙ্গ-কেন্দ্রীক প্রচলিত ধ্যান-ধারণার কথা উল্লেখ করে রহিমা বলেন, “১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েরা বাড়িতেই থাকে। তারা ছোট ভাইবোনদের যত্ন নেয় এবং পরিবারের জন্য রান্না করে।”

“আমার মা স্কুলে যাননি, আমার মেয়ে বন্ধুরাও যায়নি। অন্য মেয়েদের মতো আমিও সমাজের নিয়ম অনুসরণ করছি।’’

রোহিঙ্গা বাবা-মায়েরা ক্যাম্পে তাদের কিশোরী মেয়েদের বাড়িতে রাখার কারণ হিসেবে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথাও জানান। অথচ যেসব মেয়ে বাড়িতে থাকে তারাই শিশুবিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, লিঙ্গ-সহিংসতা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য সৃজনশীল উপায় 

২০২১ সালের নভেম্বরে ইউনিসেফ ও সহযোগীরা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের মিয়ানমারের জাতীয় পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক ও মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। মিয়ানমার কারিকুলাম পাইলট-এর অংশ হিসেবে ইউনিসেফ শিক্ষাকেন্দ্রে মেয়েদের জন্য আলাদা শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে সহায়তা করছে, যেহেতু অনেক রোহিঙ্গা বাবা-মা সহশিক্ষা কার্যক্রম অপছন্দ করেন।

ক্যাম্প ১৭-এর ১৩ বছর বয়সী রাজুমা বলে, “২০১৯ সালে আমি একটি শিক্ষাকেন্দ্রে যেতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু এক বছর না হতেই সেখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমার শরীরে পরিবর্তন আসে এবং আমি আর ছেলেদের সঙ্গে একই কক্ষে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। ম্যাডাম এসে আমাদের বলেন যে, এই বছরের শুরু থেকে শিক্ষাকেন্দ্রে মেয়েদের জন্য আলাদা শ্রেণিকক্ষ থাকবে। আমার মা এই নতুন ব্যবস্থা পছন্দ করেছেন এবং আমাকে আবার পড়াশুনা শুরু করার অনুমতি দিয়েছেন।”

মেয়েদের শিক্ষাকেন্দ্রে যাওয়া ও ফেরার সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নারীরা যাতে তাদের সঙ্গ দেন সে ব্যবস্থা করতেও ইউনিসেফ কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করছে।

স্বাগতিক কমিউনিটির একজন বাংলাদেশি শিক্ষক এবং রোহিঙ্গা কমিউনিটির একজন বার্মিজ ভাষা প্রশিক্ষক ইউনিসেফ সমর্থিত শিক্ষাকেন্দ্রে ক্লাস নেন।

একজন নারী শিক্ষকের উপস্থিতি শিক্ষায় মেয়েদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে কাজ করতে পারে।
UNICEF/UN0690295/Spiridonova
একজন নারী শিক্ষকের উপস্থিতি শিক্ষায় মেয়েদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে কাজ করতে পারে।

শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের উন্নয়নে নারী শিক্ষকদের যে ইতিবাচক প্রভাব আছে ইতোমধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন নারী শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি বিদ্যমান শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখা ইউনিসেফের অগ্রাধিকার।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কক্সবাজারে ইউনিসেফ ফিল্ড অফিসের প্রধান ড. ইজাতুল্লাহ মজিদ বলেন, “আমরা মেয়েদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে অনেক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, অর্থের সংস্থানও করেছি। সমস্যাটি বহু-স্তরের এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এমন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে যা রোহিঙ্গারা গ্রহণ ও সমর্থন করবে।”

কমিউনিটির সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ

স্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করতে কমিউনিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইউনিসেফ মেয়েদের শিক্ষিত করার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলার জন্য শত শত রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবককে তাদের প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের সঙ্গে জড়ো করছে এবং ৩০০ ধর্মীয় নেতাকেও তালিকাভুক্ত করেছে। মেগাফোন হাতে তাদের প্রায়শই ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে একটি বার্তা ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়। সেটি হলো, সব মেয়েরই নিজের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যত গড়তে স্কুলে যাওয়ার অধিকার রয়েছে।

এ ধরনের প্রচেষ্টা নুরকোলিমার মতো মেয়েদের জীবন বদলে দিচ্ছে।

রহিমা এখন বলেন, “আমি আমার মেয়েকে আগে কোনো শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠাইনি। এখন আমি পড়াশোনা করার গুরুত্ব বুঝতে পারছি। আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু আমি আমার মেয়ের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ চাই। তাকে একজন ভালো ছাত্রী হতে হবে, যাতে সে একজন শিক্ষক হতে পারে, অথবা অন্য কোনো চাকরি খুঁজে নিতে পারে।”

“ছেলেরা পড়াশোনা করে, মেয়েরা কেন তা করতে পারবে না? এটাতো মেয়েদের জন্য ভালো।’’

নুরকোলিমা এখন ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে এবং মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে পড়াশোনা শুরু করেছে। নিজের মেয়ের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত হতে দেখে রহিমার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে।

খুবই অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার পর, তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন এবং আর কখনোই পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। এটা তার সবচেয়ে বড় অনুশোচনাগুলোর একটি।

রহিমা বলেন, “যদি আমি অল্প বয়সে পড়াশোনা করতে পারতাম, তাহলে আজকে একজন শিক্ষক হতে পারতাম এবং আমার পরিবারের জন্য উপার্জন করতে পারতাম। তখন আমি ভালো করে সেটা বুঝতাম না।”

*পরিচয় সুরক্ষিত রাখার জন্য নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।