বাবার সহায়তা ও নতুন পাঠ্যক্রম: ১৩ বছর বয়সী আয়েশা বিজ্ঞান শিক্ষায় অবদান রাখছে
বাংলাদেশে নতুন স্কুল পাঠ্যক্রমে স্টেম শিক্ষার প্রতি অনেক মেয়েরাও আগ্রহী হচ্ছে
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
মাত্র ১৩ বছর বয়সে আয়েশা বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড পরিবর্তন, পাখা মেরামত ও একটি এলইডি বাল্বের নষ্ট হওয়া ফিউজ ঠিক করতে পারে। শুধু তাই নয়, সে একটি খেলনা গাড়িকে নতুন করে তার লাগিয়ে রিচার্জেবল বানাতে পারে এবং ব্যাটারির ব্যবহার কমাতে পারে।
“বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি কীভাবে কাজ করে তা আমার বাবা আমাকে শেখান। আমি ভাঙা যন্ত্রপাতি ঠিক করতে, জিনিসগুলোকে একত্রিত করতে এবং সেগুলোকে জ্বলে উঠতে দেখতে পছন্দ করি,”- বলে আয়েশা।
আয়েশার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তিনি তার নিজ শহরে টেলিভিশন সেট, ফ্যান ও অন্যান্য ছোটখাট বৈদ্যুতিক সামগ্রী মেরামতের দোকান চালাতেন। আয়েশা স্কুলে তার বিজ্ঞান প্রকল্পে যা শিখছে তার পরিপূরক কিছু ব্যবহারিক দক্ষতা তিনি তাকে শেখান। আর তাই তার দোকানের কিছু সামগ্রী এখন ভালো কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
একটি প্রগতিশীল নতুন পাঠ্যক্রম
বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (স্টেম) শেখানো হয় একটি নতুন পদ্ধতিতে। আয়েশার মতো শিক্ষার্থীরা এখন বিজ্ঞানের প্রতি তাদের ভালো লাগাকে কাজে লাগাতে পারে এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন পাঠ্যক্রমের অধীনে ব্যবহারিক বিজ্ঞান প্রকল্পের মাধ্যমে তারা যে দক্ষতা শিখছে তা প্রদর্শন করতে পারে।
“নতুন পাঠ্যক্রমটি হাতে-কলমে শেখার প্রতি বেশি জোর দেয় এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আরও বেশি সম্পৃক্ত থাকে, যেখানে আগের পাঠ্যক্রম ছিল প্রায় মুখস্থনির্ভর। আজ তারা একটি সৌরচুল্লি তৈরি করেছে, যেখানে দুই শিক্ষার্থী নেতৃত্ব দিয়েছে এবং বাকিরা পর্যবেক্ষণ করেছে ও অন্যভাবে অবদান রেখেছে,”- আয়েশার বিজ্ঞান শিক্ষক নন্দা রানী দাস বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন।
নতুন পাঠ্যক্রমটি শিশুদের জন্য বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করেছে। পুরোনো পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নবম শ্রেণি থেকে নৈর্বচনিক ছিল, যা প্রায় সময়েই শিক্ষার্থীদের আগের পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে তাদের বাণিজ্য, মানবিক বা বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নিতে বাধ্য করত। নতুন পাঠ্যক্রম দশম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করার আগ পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান অধ্যয়নের সুযোগ দেয়। আয়েশার শিক্ষক বলেন, ‘‘এটি বিজ্ঞান শিক্ষাকে উৎসাহিত করবে, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে।’’
স্টেম শিক্ষায় মেয়েদের আরও বেশি আনার জন্য জেন্ডারভিত্তিক প্রচলিত ধ্যান-ধারণাগুলো ভেঙে দেওয়া
২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করা মিসেস দাস বলেন, ‘‘শুধু যে পাঠ্যক্রমই বদলে গেছে তা নয়। আগে কম সংখ্যক মেয়ে স্কুল শেষ করত। এমনকি যারা স্কুলে থাকত তারাও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিতে চাইত না। ধারণাটি এমন ছিল যে, মেয়েরা তৈরিই হয় বিয়ের জন্য। আর তাই তাদের জন্য খুব বেশি পড়াশোনা করা গুরুত্বপূর্ণ নয়,”- বলেন মিসেস দাস।
জেন্ডারভিত্তিক প্রচলিত ধ্যান-ধারণাগুলো স্টেম শিক্ষা নিয়ে মেয়েদের উৎসাহ এবং এতে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত করতে পারে। পাঠ্যক্রম ও শিক্ষার উপকরণগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও অসম নিয়মগুলোকে শক্তিশালী করতে পারে। যদি স্টেম শিক্ষার বিষয়গুলোকে আকর্ষণীয় ও ইন্টারেক্টিভ বা মিথস্ক্রিয় করা হয়, তবে এটি মাধ্যমিক শিক্ষার দিকে এগিয়ে যেতে আরও বেশি সংখ্যক ছেলে-মেয়েকে আকৃষ্ট করবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশোনার পর শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমিয়ে দেবে।
মিসেস দাস বলেন, “সৌভাগ্যবশত, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে। আমার সময়ের তুলনায় আজকে মেয়েদের জন্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া সহজ। মেয়েরা শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও বেশি সমর্থন পায়।”
সব দিক থেকে পাওয়া সমর্থন আয়েশার জন্য শক্তিশালী ভিত তৈরি করে
আয়েশা সব সময়ই ছিল আলাদা, বলেন তার বাবা, যিনি আয়েশা ও তার দুই ভাইসহ নিজের তিন সন্তানকে নিজের ব্যবসা শেখান।
আয়েশার বাবা বলেন, “আয়েশা যা হতে চায় তাই হতে পারবে এবং যা করতে তার ভালো লাগে সেটাই করতে পারবে। আমি তাকে যা শিখিয়েছি তা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জীবনভিত্তিক দক্ষতা। একটি মেয়ে যদি জানে কীভাবে সাধারণ যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হয়, তাহলে সে তার সম্প্রদায়কে নানাভাবে সাহায্য করতে পারে এবং আমাদের আরও বেশি বেশি নারী ইলেকট্রিশিয়ান প্রয়োজন।”
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম সংস্কার এবং পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কল্যাণ ও চাকুরির যোগ্যতার বিষয়গুলোকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে ইউনিসেফ বাংলাদেশ জেন্ডার ট্রান্সফর্মেটিভ এ্যাপ্রোচে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। লক্ষ্য হচ্ছে, শিশু ও তরুণদের অংশগ্রহণ এবং এমন একটি বিশ্ব গঠন করতে সহায়তা করা, যার জন্য উদ্ভাবন ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। ২০২২ সালে ৬২টি স্কুলে পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করার পর সরকার ২০২৩ সাল থেকে সব স্কুলে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যক্রম চালু করেছে, যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্টেম শিক্ষা বিশ্বে বিচরণের দরজা খুলে দিয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম চালুর জন্য ইউনিসেফ তার সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের এডুকেশন সেকশনের প্রধান দীপা শঙ্কর এ বিষয়ে বলেন, "বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা আয়েশার মতো মেয়েদের সক্ষম ও সম্পদশালী হতে ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে নিজস্ব ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করে। এটি তাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে এবং কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের সীমিত সুযোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এটি দৈনন্দিন জীবনে তাদের উদ্ভাবক হিসেবে দেখার পথ তৈরি করে।”
আয়েশা সৌরজগৎ পুনরায় তৈরি করা এবং স্কুলে সোলার ওভেন বানানো বেশ উপভোগ করে। এই ধরনের ব্যবহারিক প্রকল্পের মাধ্যমে সে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে বিশ্ব কীভাবে কাজ করে। এর মধ্য দিয়ে সে একজন উদ্ভাবকের মতো চিন্তা করতে শিখছে। বাড়িতে সে তার বাবার কাছ থেকে শেখা অব্যাহত রেখেছে এবং আশা করে, একদিন সে প্রকৌশলী হবে।