বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহার উপযোগী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের পথে তরুণ উদ্ভাবকরা
জেনারেশন আনলিমিটেড ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জে বিশ্বজয়ীদের মধ্যে বাংলাদেশের টিম বিডি হাইওয়ে টারবাইন

- বাংলা
- English
জেনারেশন আনলিমিটেড ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ-২০২২ এর ১০ টি বিজয়ী দলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের ‘বিডি হাইওয়ে টারবাইন’। দলটিতে রয়েছে আবদুল্লাহ আল আরাফ (২৫), জোহোরা গুলশান আরা (২৫) ও রাহাত উদ্দিন (২৫)। জেনারেশন আনলিমিটেড ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতা। সারা বিশ্বের তরুণদের নিজেদের কমিউনিটিতে বিদ্যমান সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে নতুন ও পরিবেশ-বান্ধব উপায় উদ্ভাবন করে তাদের বাস্তবে রূপ দিতে এই প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়।
‘বিডি হাইওয়ে টারবাইন’ ধারণাটি এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলা ও অ-নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের ওপর নির্ভরতা কমানোর এক সম্মিলিত প্রচেষ্টা থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কার্বন নির্গমন, যার ফল ভোগ করে বিভিন্ন কমিউনিটি। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবও রয়েছে। যেমন- এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন রোগের মহামারির ঝুঁকি বাড়ে । এই সংকটের দ্রুত ও টেকসই সমাধানে এই তরুণ উদ্ভাবকরা নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগানোর নতুন উপায় উদ্ভাবনে কাজ করছে।
বিডি হাইওয়ে টারবাইন’ ও নবায়নযোগ্য শক্তি
কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো অ-নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের ওপর বাংলাদেশ অনেক বেশি নির্ভরশীল। তবে দিন দিন এই নির্ভরশীলতা কমছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে (ক্লইমেট-নিউট্রাল) কাজ করছে এবং উইন্ড টারবাইন স্থাপন করেছে, তারপরও প্রচলিত উইন্ড টারবাইনের জনপ্রিয়তা এদেশে এখনও কম। এর কারণ মূলতঃ শব্দদূষণ ও পরিবেশের উপর এর প্রতিকূল প্রভাব।
মহাসড়ক, উপকূলীয় এলাকা ও নদীর ধারে বসানোর উপযোগী করে তৈরী এই বিডি হাইওয়ে টারবাইনের নকশা । এতে ভার্টিকাল-অ্যাকসিস উইন্ড টারবাইন রয়েছে যা ব্যস্ত মহাসড়ক ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে নবায়নযোগ্য শক্তির কেন্দ্রে পরিণত করে। দ্রুত চলমান যানবাহন ও প্রকৃতির বাতাস থেকে উৎপন্ন গতিশক্তির মাধ্যমে পরিচালিত এই টারবাইন পরিবেশবান্ধব একটি বিকল্প। অনুভূমিক টারবাইনের মতো এই ভার্টিকাল বা খাড়া টারবাইনগুলো পাখির জন্য কোনো হুমকি তৈরি করে না। এমনকি শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেও এগুলো কার্যকর।
বিডি হাইওয়ে টারবাইনের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা রাহাত উদ্দিন ব্যাখ্যা করে বলেন, “সম্পূর্ণ নতুন আমাদের এই যন্ত্রটি অত্যন্ত কার্যকরী। এর নানামুখী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। যেমন, এটি দিনে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা পুরোদমে কাজ করতে পারে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে সড়কবাতি ও ট্র্যাফিক সিগন্যাল জ্বালানো এবং টোল গেইট পরিচালনাসহ বিভিন্ন কাজ করা যেতে পারে। এই টারবাইন সৌর শক্তির সঙ্গেও ভালোভাবে মিলে যায়। কারণ, শক্তি উৎপাদনের সময় বায়ু ও সূর্য উভয়েরই বিপরীত প্যানেল প্যাটার্ন কাজ করে।”
টেকসই উদ্ভাবন
তাদের উদ্ভাবনী এই প্রযুক্তি কাঠামোর সাথে সংযুক্ত রয়েছে বেশ কিছু সেন্সর এবং উন্নত একটি আইওটি প্ল্যাটফর্ম যা শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি যেকোন শহরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক যেমন তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বাতাসে কারবন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাও (CO2) পরিমাপ করে। তাছাড়া, একটি মোবাইল অ্যাপ দিয়ে বিডি হাইওয়ে টারবাইন দ্বারা উৎপাদিত শক্তি ও অন্যান্য সঠিক উপাত্ত সহজেই পাওয়া যায়।
জেনারেশন আনলিমিটেড ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ ২০২২-এর মাধ্যমে পরিচিত বৈপ্লবিক ধারণা ‘বিডি হাইওয়ে টারবাইন’ কে একটি সফল ব্যবসায় রূপ দেয়া সম্ভব। বুটক্যাম্প থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক প্রোটোটাইপটিকে সাজানো, যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা তৈরির অর্থের যোগান (সীড ফান্ড), কক্সবাজারে পরীক্ষামূলক স্থাপনসহ বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে বিডি হাইওয়ে টারবাইন’ একটি ব্যবসা সফল পরিবেশ-বান্ধব বিপ্লবের রূপ নিচ্ছে।
বাংলাদেশে জেনারেশন আনলিমিটেড ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ অনুষ্ঠিত হয় জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম, এসআইওয়াইবি বাংলাদেশ, টেকনোভেশন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। আর এই কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয় ইউনিসেফ।
তরুণ উদ্ভাবকদের ক্ষমতায়ন
জেনারেশন আনলিমিটেড ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ-২০২২ এর আন্তর্জাতিক পর্বটি অনুষ্ঠিত হয় ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে, ১৯টি প্রতিযোগী দল থেকে প্রদর্শনপর্ব বা জাতীয় পিচিং ইভেন্টের মাধ্যমে জুরি বোর্ড বাংলাদেশের দুটি দলকে নির্বাচন করে আন্তর্জাতিক পর্বে অংশগ্রহণের জন্য। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে ইউনিসেফ বাংলাদেশের কার্যালয়ে ২০টি দেশ থেকে অংশগ্রণকারী মোট ৪০টি দলের মধ্যে থেকে ১০টি দলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিডি হাইওয়ে টারবাইন তার মধ্যে একটি। বিজয়ী অন্য নয়টি দলের সঙ্গে বিডি হাইওয়ে টারবাইনও তাদের উদ্যোগে সরাসরি বিনিয়োগের জন্য ১০,০০০ মার্কিন ডলারের ফান্ড পাবে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, “বিডি হাইওয়ে টারবাইন টিম প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া সমস্ত কিছুর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে এবং পরিবেশের ক্ষতি করা ছাড়াই আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের দারুণ এক উপায় বের করেছে। এটি তরুণদের বিরাট এক অর্জন। বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় অর্জন। এই তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য আমি গর্বিত।”
বিডি হাইওয়ে টারবাইন টিমকে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে তাদের এই উদ্ভাবনকে পৌঁছে দিতে আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। জোহোরা গুলশান আরা বলেন, “দলে আমরা প্রত্যেকে কোন না কোন আবেগ, স্থায়িত্ব, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কমিউনিটির প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত। অবশ্যই আমরা এই সীড ফান্ড, মেন্টরশিপ, জ্ঞান-বিনিময় কর্মসূচি এবং সুযোগগুলো কাজে লাগানোর মাধ্যমে আপনাদের ভবিষ্যতের স্মার্ট ও নবায়নযোগ্য শক্তির শহর উপহার দিতে সক্ষম হব।”
নবায়নযোগ্য শক্তির দারুণ সম্ভাবনার মধ্যে বিডি হাইওয়ে টারবাইন আমাদের সামনে একটি আশার আলো। ইউনিসেফ এই তরুণ স্বপ্নদর্শীদের সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারণ, তারা আরও টেকসই ভবিষ্যতের পথ তৈরি করছে।