বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা কোভিড-১৯ টিকা দিতে প্রস্তুত

একটি বিশাল হাম-রুবেলা টিকা কার্যক্রম শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ক্ষেত্রে আশার সঞ্চার করেছে

ক্যারেন রেইডি
জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির সময় বিশাখা চাকমা তার ছোট ছেলে তুহিন মার্মাকে (৭) হাম-রুবেলার টিকা দেওয়ার জন্য রাঙ্গামাটিতে নিয়ে আসেন।
UNICEF Bangladesh/2020/Mawa
25 ফেব্রুয়ারি 2021

পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশঃ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ইয়োচুঙ্গু মারমা গত দশ বছরে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।এতো উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও, প্রত্যন্ত কমিউনিটির কাছে জীবন রক্ষাকারী উপকরণ পৌঁছে দিতে ইয়োচুঙ্গু এবং তার টিকা দলকে পাবর্ত্য চট্রগ্রামের অনেক অঞ্চলে এখনও পায়ে হেঁটে যেতে হয়।

“এখন অনেক রাস্তা হয়েছে”, বলেন বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের কয়েকটি জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ইয়োচুঙ্গু। “তবে, এখনও ডিসেম্বর মাসে টিকাদান কর্মসূচি শুরুর আগের দিন আমাদের শহর থেকে যেতে হয়। ধূলাবালির রাস্তা শেষ হওয়ার পরে আমরা কয়েক ঘন্টা হাঁটি। তারপর আমরা গ্রামের বয়স্ক কাউকে খুঁজে বের করি এবং তার বাড়িতে রাত্রি যাপনের অনুরোধ করি। পরের দিন সকাল ৯ টায় টিকা দেওয়া শুরু হয়।”

এধরনের কঠিন যাতায়াত স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য শুধুমাত্র শিরীরিক চ্যালেঞ্জই বয়ে আনা না, এর সাথে যুক্ত হয় অন্যান্য চ্যালেঞ্জও। সঠিক তাপমাত্রায় ভ্যাকসিনগুলোর সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে টিকার বাক্সগুলিকে আইস ব্লক দিয়ে প্যাক করতে হয়। শিশুদেরকে টিকা দেওয়ার আগে ভ্যাকসিনগুলো যেন ভালো থাকে তা নিশ্চিত করতে তাপমাত্রা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ইয়োচুঙ্গু আরও বলেন, “বিকেল বেলা টিকা দেওয়া শেষ হলে আইস ব্লকগুলো গরম হয়ে যায় এবং অবশিষ্ট টিকার ডোজগুলোকে অপসারনের জন্য চিহ্নিত করা হয়।”

সম্প্রতি দেশজুড়ে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ শিশুকে হাম ও রুবেলার টিকা দেওয়ার বিশাল কাজটি যারা সম্পন্ন করেছেন এমন হাজার হাজার বাংলাদেশি স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে ইয়োচুঙ্গু একজন। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার এই টিকা অভিযানটি সম্পন্ন করে।

ইয়োচুঙ্গু মারমা এবং তার দল পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছেন।
UNICEF Bangladesh/2020/Mawa
ইয়োচুঙ্গু মারমা এবং তার দল পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছেন।

২০২০ সালের মার্চ মাসে এই কর্মসূচী শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এটি স্থগিত করা হয়। এমনকি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে একবার চালু করার পরে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ছিল যে, এবারের কার্যক্রম অন্যবারের চেয়ে ভিন্নতর হবে। অবশেষে টিকা দেওয়ার জায়গাগুলিতে ভিড় এড়াতে তিন সপ্তাহের পরিকল্পিত কার্যক্রমকে ছয় সপ্তাহ ব্যাপী চালানো হয়।

ইউনিসেফের সহায়তায় প্রস্তুতকৃত টিকা দেওয়ার স্থানে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর্মী, পিতামাতা এবং শিশুরা কঠোর নির্দেশনা অনুসরণ করেছে। মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত ধোয়ার বিষয়গুলো তাদের কঠোরভাবে অনুশীলন করতে দেখা গেছে।

বিশাখা চাকমা দুই সন্তানের মা। তাদের পাহাড়ের উপর বনের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে নিকটস্থ স্বাস্থ্য ক্লিনিকে পৌঁছানো ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না।

বিশাখা বলেন, “টিকাদান কর্মসূচির বিষয়টি আমি আমার এক প্রতিবেশির কাছ থেকে শুনে আমার ছেলেদের টিকা দিতে নিয়ে এসেছি। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন হামের ঘটনা দেখেছি। বিষয়টি আমার মনে আছে।এটি খুব মারাত্মক রোগ এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এটি ছড়ায়।”

জাতীয় হাম-রুবেলা টিকা কম©সূচির অংশ হিসাবে রাঙ্গামাটির শিশুদের জন্য একটি হাম-রুবেলার ভ্যাকসিন প্রস্তুত করছেন ইয়োচুঙ্গু মারমা।
UNICEF Bangladesh/2020/Mawa
জাতীয় হাম-রুবেলা টিকা কম©সূচির অংশ হিসাবে রাঙ্গামাটির শিশুদের জন্য একটি হাম-রুবেলার ভ্যাকসিন প্রস্তুত করছেন ইয়োচুঙ্গু মারমা।

কোল্ড চেইনের সক্ষমতা বৃদ্ধি

ইউনিসেফ গত চার বছরে রেফ্রিজারেশন সরঞ্জাম, কোল্ড বক্স এবং টিকা বহনকারী বাক্স সংগ্রহের পাশাপাশি লজিস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম উন্নত করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশে কোল্ড চেইন সক্ষমতা জোরদার করতে ১২০ লক্ষ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

কোল্ড চেইনে যে কোনও সমস্যা নেই কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিনিয়োগ সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এছাড়াও, নিরাপদ ও কার্যকর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ভ্যাকসিন প্রদান করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সম্পর্কে ইয়োচুঙ্গু’র মতো স্বাস্থ্যকর্মীরা যে যথেষ্ট দক্ষ কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিনিয়োগ সে বিষয়টি নিশ্চিত করতেও সহায়তা করে।  

হাম-রুবেলা টিকা কার্যক্রমে ইউনিসেফের এই বিনিয়োগ কোভিড-১৯ টিকাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপশি বাংলাদেশের সকল টিকা কার্যক্রমের সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে এবং অমুল্য অনুশীলন হিসাবে কাজ করবে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চন্দ্রসেগারার সোলোমান বলেন যে কোভিড-১৯ এর উপর দৃষ্টি দিতে গিয়ে অন্য রোগগুলিকে পিছনের দিকে ঠেলে দেয়া যাবে না। "আমরা রুটিন টিকাদান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কোভিড-১৯ টিকাদান প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছি। এটি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, তবে প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো আমরাও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।"

ইয়োচুঙ্গু গর্ব করে বলেন, “যদি হাম-রুবেলা টিকাদান কর্মসচিকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরীক্ষা হিসাবে ধরা হয়, তবে আমি বলব সেখানে আমরা যথেষ্ট দক্ষতার সাথে পাশ করেছি।”