দ্বিতীয় সুযোগ: কিশোর অপরাধে আটক অবস্থা থেকে মুক্তি ও স্কুলে ফিরে আসা
ভার্চুয়াল আদালত যেভাবে আরও শিশুবান্ধব বিচার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
মোহাম্মদ আল আমিনকে যখন আটক করা হয় তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৪ বছর। তার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ ছিলো। একারণে তাকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে একটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নেয়া হয়। বাড়ি থেকে বেশ দূরের একটি জায়গা কেমন হবে সে বিষয়ে আল-আমিনের কোনো ধারণাই ছিলো না। একারণে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাকে একটি কোলাহলপূর্ণ জায়গায় আনা হয়, এবং সেখানে অনেক অল্প বয়সী কিশোরকিশোরী ছিলো।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে দেড়শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বানিয়াচং গ্রামে থাকেন আমিনের মা জাফুরা বেগম। তার ছেলের সাথে কী হতে পারে এমনটা ভেবে তিনি বেশ আতঙ্কে ছিলেন।
“আল আমিনকে যখন আটক করা হয় তখন আমি ভেঙে পড়েছিলাম। আমি কীভাবে থাকবো সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম। আমি জানতাম না, কোথায় তাকে খুঁজে পাবো এবং সে কীভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করবে। এমনকি তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার মতো কোনো টাকা আমার কাছে ছিলো না।”
আল-আমিন নয় মাস আটক ছিলো। এসময় সে এমন আরো অনেক বন্দী শিশুদের সাথে তার পরিচয় হয়, যারা তাকে পছন্দ করতো। সেসব শিশুরা তাদের মামলা মীমাংসার জন্য কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর ধরে অপেক্ষা করছে।
অবশেষে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক স্থাপিত একটি ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে সে মুক্তি লাভ করে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ২০২০ সালের মে মাসে ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থা চালু করা হয়।

পাঁচ হাজারেরও বেশি শিশু তাদের পরিবারের সাথে পুনরায় একত্রিত হয়েছে
অনেক জমে যাওয়া শিশু সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে সহায়তার জন্য ভার্চুয়াল শিশু আদালত স্থাপন করা হয়। শিশুদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলো যাদেরকে ছোট খাটো অপরাধের জন্য আটকে রাখা হয়েছিলো।
উন্নয়ন কেন্দ্রের জনাকীর্ণ অবস্থার কারণে শিশুরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলো। ভার্চুয়াল শিশু আদালত স্বাস্থ্যগত এ উদ্বেগ দূর করতে সহায়তা করে।
আল-আমিন বলেন, “শিশুদের অনেককে মুক্তি পেতে দেখে আমিও মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠি। মেয়েরাই প্রথম মুক্তি পায় যা জেনে আমাদেরও মুক্তির প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আমিও খুব দ্রুত মুক্তি পাই এবং মায়ের কাছে ফিরে আসি।”
উন্নয়ন কেন্দ্রেই সুসংবাদটি পাওয়ার কথা স্মরণ করে আল-আমিন বলেন, উন্নয়ন কেন্দ্রের একটি কক্ষকে অস্থায়ী আদালত বানানো হয়েছিলো। বিচারকের সাথে কথা বলার জন্য সেখানে একটি ভিডিও লিংক ছিলো। উন্নয়ন কেন্দ্রের একজন প্রবেশন অফিসার তাদের জামিনের আবেদন করেছিলেন ।
বাংলাদেশের প্রথম ভার্চুয়াল শিশু আদালত স্থাপনের পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি শিশুকে জামিন এবং কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এদের বেশিরভাগই তাদের পরিবারের সাথে পুনরায় বসবাস করছে। এখন পর্যন্ত মাত্র দু’জন শিশু পুনরায় অপরাধে জড়িয়েছে।

ভার্চুয়াল শিশু আদালতগুলোকে স্থায়ী করার আহ্বান
বাংলাদেশে করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলো তুলে নেয়ার পর ২০২১ সালের জুলাই মাসে ভার্চুয়াল আদালতগুলো স্থগিত করা হয়। ভার্চুয়াল আদালতগুলোকে দেশের স্থায়ী আদালতে রূপান্তরিত করার আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।
শিশুদের মামলার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভার্চুয়াল আদালত তাদেরকে স্কুলে থাকার সুযোগ দিতে পারে। এছাড়াও স্বশরীরে আদালতে হাজির না হতে হলে দূর পথে ভ্রমনে শিশুদের যে লজিস্টিক এবং আর্থিক অসুবিধায় পড়তে হয় তাও এড়ানো সম্ভব হতো ।
শিশুদের মুক্তির প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য ইউনিসেফ উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোকে অব্যাহতভাবে সহায়তা করছে। শিশুদেরকে তাদের পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দিতে এবং শিশুদের বাড়িতে থাকা নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ সমাজসেবা বিভাগের সাথেও কাজ করছে। ইউনিসেফ মুক্তি পাওয়া শিশুদের আইনি ও মানসিক সহায়তা ছাড়াও স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে। সমাজে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে এর সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাভাবিক জীবন ও স্কুলে ফেরা
আটক থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, আল-আমিনের মামলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একজন প্রবেশন অফিসার এবং তার প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করার জন্য দু’জন সমাজকর্মীকে নিযুক্ত করা হয়।
আল আমিন জানায়, “রানা ভাই ও রেদওয়ান ভাই (সমাজকর্মী) এখন আমার দেখাশোনা করেন। আমি পড়াশোনা করছি কিনা বা সঠিক পথে আছি কিনা সে ব্যাপারে তারা সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নেন।”

বাড়ি ফেরার পর ছেলের জীবনযাপন সহজ করতে আল আমিনের মা জাফুরাকে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। জাফুরা সেই অর্থ দিয়ে একটি চায়ের দোকান করেন। সেটি পরিচালনা করতে আল-আমিন তার মামাকে সহায়তা করে।
জাফুরা বলেন, “কর্মকর্তাদের সহায়তায় আল-আমিনের ফিরে আসার পর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। সে স্বাভাবিক পথে ফিরে এসেছে। সে এখন মামার সাথে চায়ের দোকানে কাজ করে। এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ হয়। আল-আমিন পড়াশোনায় ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছে।”
ছেলের দ্বিতীয় সুযোগের কথা চিন্তা করে জাফুরা বলেন, “আমি প্রার্থনা করি যে, উন্নয়ন কেন্দ্রে আটকে থাকা অন্য সব শিশুরাও যেনো তাদের বাবা মা ও প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়।”