দিনমজুর থেকে উদ্যোক্তা: তৈয়বার বিজয়ের গল্প

প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহায়তা বদলে দিচ্ছে কক্সবাজারের নারীদের জীবন।

তাসনীম কিবরিয়া
Taiyba, 31, holds a pigeon that she is raising at her home in Teknaf, Cox’s Bazar.
UNICEF Bangladesh/2023/Sujan  
29 এপ্রিল 2024

বিয়ের পর নিজের জীবন নিয়ে বেশ খুশিতে ছিলেন তৈয়বা। ২০১৫ সালে তিনি তার কক্সবাজারের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরে পাড়ি দেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন, তার স্বামীর আরেক স্ত্রী আছে।

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তৈয়বা বলেন, “প্রতারণা সত্ত্বেও আমি আমার স্বামীর তৈরি আলাদা একটি বাড়িতে থাকতাম। আমাদের তিনটি সন্তান হয়। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে (স্বামী) এবং তার আগের স্ত্রী আমার ও আমার সন্তানদের উপর নির্যাতন করতে শুরু করে।”

পরে সমাজের নেতাদের সহায়তায় তৈয়বা তার সন্তানদের নিয়ে কক্সবাজারে ফিরতে সক্ষম হন। সেখানে তার ছোট ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু ছোট একটি জায়গায় ওই পরিবারের আটজনের সঙ্গে থাকতে গিয়ে তাদের পরিস্থিতি দ্রুতই অসহনীয় হয়ে ওঠে।

আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকায় তৈয়বা টাকা উপার্জন করতে সে সময় হিমশিম খাচ্ছিলেন। ফলে নিজের পরিবারের জন্য আলাদা বাসা নিতে কিংবা সন্তানদের চাহিদা মেটাতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে তৈয়বা তার বড় ছেলেকে দিনমজুর হিসেবে কাজে লাগাতে বাধ্য হন, যদিও তিনি চেয়েছিলেন ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাক। এদিকে পুষ্টিকর খাবারের অভাবে তার তিন সন্তানেরই ওজন ক্রমশ কমতে থাকে।

তৈয়বা বলেন, “সংগ্রামের সেই দিনগুলোতে আমি দিনে মাত্র এক বা দুইবার খেতাম। অন্যের বাড়িতে কাজ করতাম। সেটা ছিল এক কঠিন সময়। সন্তানদের খাবার জোগাড় করতে আমি প্রখর রোদের মধ্যেও ক্ষেতে গিয়ে কাজ করেছি।” 

 

নিজের হাতেই যখন ভাগ্যের চাকা  

Taiyba feeds the chickens in the pen behind her home.
UNICEF Bangladesh/2023/Sujan  
বাড়ির পেছনে গড়ে তোলা খামারে মুরগিকে খাওয়াচ্ছেন তৈয়বা।

কক্সবাজারে ফিরে আসার তিন বছর পরও তৈয়বা সন্তানদের নিয়ে তার ভাইয়ের বাড়িতেই থাকছেন। কিন্তু সেই বাড়ির পেছনে এখন একটি নতুন বাগান হয়েছে, যেটি মৌসুমী বিভিন্ন সবজিতে ভরা। এছাড়া পাশেই গড়ে তোলা তার একটি খামারে হেঁটে বেড়ায় হাঁস-মুরগি।

২০২১ সালের আগস্টে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ইউনিসেফের নিউট্রিশন সেনসিটিভ ক্যাশ প্লাস প্রজেক্টে অংশগ্রহণের জন্য কক্সবাজারের ২ হাজার নিম্ন আয়ের নারীকে নির্বাচন করা হয়। তৈয়বা তাদেরই একজন। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল নারী-প্রধান পরিবার, তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা নারী, যাদের পাঁচ বছরের কম বয়সী সন্তান রয়েছে, শারীরিকভাবে যারা অক্ষম, গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মা এবং যাদের আয়সীমা ১০ হাজার টাকার নিচে অথবা যাদের সামান্য জমি রয়েছে- এমন নারীদের সহায়তা করা। অংশগ্রহণকারীদের আয়ের উৎস হিসেবে জামাকাপড় সেলাই ও মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস তৈরির ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়।

কক্সবাজারে কম বয়সী সন্তান রয়েছে এমন অনেক পরিবার পুষ্টিকর খাবার ও যথাযথ পুষ্টি পায় না, ফলে সেখানে অপুষ্টির হার বেশি। ২০২৩ সালে টেকনাফ উপজেলায় করা এক পুষ্টি জরিপ অনুসারে, সেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ২৪ শতাংশ শিশু খর্বকায় অর্থাৎ বয়সের তুলনায় বেশ ছোট এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু শীর্ণকায়, যার অর্থ হলো তারা বয়সের তুলনায় বেশ শুকনা এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশ কম। জলবায়ু সংকট, কোভিড-১৯ মহামারি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনে এলাকাটিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার চেষ্টায় তৈয়বা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দুই দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মুরগি পালন শুরু করেন। তিনি একটি মুরগির খামার গড়ে তোলেন এবং প্রকল্পের মাধ্যমে পাওয়া ১২টি মুরগি দিয়ে খামারটি শুরু করেন। প্রকল্প থেকে তাকে মুরগির খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীও দেওয়া হয়। 

“এখন আমি মুরগি, হাঁস ও ডিম বিক্রি করি,” গর্বের সঙ্গে বলেন তৈয়বা। তিনি আরও বলেন, “আমার ২০টি মুরগি, ৩টি হাঁস ও ৯টি হাঁসের বাচ্চা আছে। আগে ঠিকমতো খাবার জোগাড় করাই আমার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু এখন যেহেতু আমি বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে ভালো আয় করছি, তাই আমার পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে পারছি, তাদের সুষম খাবারও দিতে পারছি। আমি এখন প্রায় প্রতিদিনই তাদের ডিম ও দুধ খাওয়াই। পুষ্টিকর খাবার রান্না করি, যাতে আমার সন্তানরা সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে।’’

প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর থেকে তৈয়বা তার আয়ের উৎসে বৈচিত্র্য আনতে শুরু করেছেন, যার অংশ হিসেবে ছাগল ও কবুতর পালন করছেন। তিনি বাড়ির পেছনে একটি বাগান তৈরি করেছেন মৌসুমী সবজি লাগানোর জন্য। বাড়িতে চাষ করা সবজি দিয়ে কীভাবে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে হয় তা শিখতে রান্নার প্রশিক্ষণ ক্লাশেও অংশ নিয়েছেন তিনি।

পোলট্রি খামার ও সবজি চাষ ছাড়াও আয় বাড়াতে তৈয়বার দৃঢ়সংকল্প তাকে জামাকাপড় সেলাইয়ের কাজ শিখতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি টাকা জমিয়ে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। এখন নিজের পরিবারের জন্য তিনি জামাকাপড় সেলাই করেন। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও কাজ পান। সেলাইয়ের মাধ্যমে মাসে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন তৈয়বা। তাই তিনি এখন তার সন্তানদের জন্য আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন। 

তৈয়বার বড় ছেলে দিনমজুর হিসেবে কাজ করত। তৈয়বা সম্প্রতি তাকে একটি অটোরিকশা কিনে দিয়েছেন। ওই অটোরিকশা দিয়ে আয়াজ শহরে যাত্রীদের আনা-নেওয়া করে। এ থেকে প্রতিদিন তার প্রায় ১ হাজার টাকার মতো আয় হয়। কাছাকাছি কোথাও এক টুকরা জমি কেনার লক্ষ্যে সঞ্চয় শুরু করেছেন তৈয়বা। ওই জমিতে তিনি নিজের একটি বাড়ি করবেন। নতুন দক্ষতা ও তা কাজে লাগিয়ে আয় করতে পারায় তৈয়বা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তার বিশ্বাস, এখন তিনি তার সন্তানদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে পারবেন।

তৈয়বা বলেন, “আমি এখন আমার সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে পারি। তাদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও কিনতে পারি। আমার সন্তানরা প্রতিদিন মাংস, ডিম, মাছ ও বাড়িতে চাষ করা সবজিসহ পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে। আমি তাদের ভালো কাপড়চোপড় দিতে পারি।” তৈয়বা আরও বলেন, ‘‘আমরা অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু এখন আমাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।”