তিন মাস বয়সী সুলাইমান নিউমোনিয়াকে পরাজিত করেছে
একটি নতুন মডেল ক্লিনিক বাংলাদেশের বস্তিগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার পেছনে খরচের বোঝা কমিয়ে দিচ্ছে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
তিন মাস বয়সী সুলাইমানের জন্ম ঢাকার শ্যামপুর বস্তির একটি ঘরে। সেখানে জন্মের সময় তার মাকে সহায়তা করেছিলেন এক প্রতিবেশী, যিনি একজন প্রাক্তন নার্স। সুলাইমান ও তার বাবা-মা অন্য দুটি পরিবারের সঙ্গে এখন একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। সেখানে প্রতিটি পরিবারের একটি করে ব্যক্তিগত কক্ষ থাকলেও বাথরুম ও রান্নাঘর ভাগাভাগি করতে হয়।
ঢাকার শ্যামপুরে রয়েছে বড় বড় কারখানা ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক ও টিনের ঘর। এটি রাজধানীর একটি ব্যস্ত শিল্প এলাকা যার একদিকে জুতার কারখানা, স্টিল মিল, আসবাবপত্রের দোকান, ওয়েল্ডিংয়ের দোকান ও পোশাক কারখানা এবং অন্যদিকে রয়েছে সরু গলির সাধারণ বস্তি ঘর।

নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই
সুলাইমান বেশ কয়েকদিন ধরে নিউমোনিয়ায় ভুগছিল। ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতো এবং যখন ফুসফুসে বাতাস নিতো তখন তার কষ্ট হতো, সে ঘড়ঘড় শব্দ করতো। অসুস্থ সুলাইমান সারারাত কান্নাকাটি করতো, কাশতো এবং ঘুমাতে পারতো না। তার বাবা-মা তাকে তাদের বাড়ির কাছে ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত ‘আলো’ ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে তার চিকিৎসা হয়।
একদল নার্স ও ল্যাব অ্যাসিস্টেন্টকে সঙ্গে নিয়ে ডা. মৌমিতা সরকার ও আরেকজন চিকিৎসক শ্যামপুর ‘আলো’ ক্লিনিকে সকালের শিফট চালান। ডা. মৌমিতা বলেন, ‘নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের অবস্থা দ্রুত খুব খারাপ হতে পারে, সুস্থ খেলাধুলা করছে এমন শিশুরও খুব দ্রুত শ্বাস কষ্ট শুরু হতে পারে।’
‘চিকিৎসার সময় ছোট শিশুদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন,’ যোগ করেন তিনি।
সুলাইমানের বাবা-মা সাত দিন ধরে প্রতিদিন তাকে ক্লিনিকটিতে নিয়ে যান যেখানে সরাসরি তার ফুসফুসে ওষুধ পৌঁছে দিতে নেবুলাইজার ব্যবহার করাসহ তার চিকিৎসা করা হয়।
‘আলো ক্লিনিকটি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি, তাই আমাদের ছেলেকে এখানে নিয়ে যাওয়া সহজ। অন্য হাসপাতালগুলো অনেক দূরে এবং সেখানে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা খরচ হয়। প্রথমত, আমাদের যাতায়াতে খরচ করতে হবে, তারপর পরামর্শ নেওয়া, চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য টাকা দিতে হবে। এই খরচ বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই। আলো ক্লিনিকে সবকিছু বিনামূল্যে পাওয়া যায়,’ ব্যাখ্যা করে বললেন সুলাইমানের বাবা মিন্টু।
একটি বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা
বাংলাদেশের শহুরে বস্তিগুলোতে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির, যার অর্থ হচ্ছে অপুষ্টির কারণে তারা তাদের বয়সের তুলনায় বেশি খাটো। এই হার দেশজুড়ে খর্বাকৃতিতে আক্রান্ত শিশুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। জাতীয় পর্যায়ে এই হার ২৮ শতাংশ, যা কিনা অগ্রহণযোগ্যভাবে বেশি। উপরন্তু, বস্তিতে মাত্র ৫৬ শতাংশ প্রসব দক্ষ জন্ম পরিচারকের সহায়তায় হয়, যেখানে বস্তির বাইরে শহরের অন্য এলাকাগুলোতে এই হার ৭৪ শতাংশ।
যদিও বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্যসেবা দারুণভাবে প্রসারিত করেছে, তবে শহর অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় অসংলগ্ন। স্বাস্থ্যসেবা খাতে কম সরকারি ব্যয়ের অর্থ হলো, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তারাই বেশি অর্থের যোগান দেয় যারা অসুস্থ এবং যাদের চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য উচ্চ মূল্য পরিশোধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
সুলাইমানের পরিবার এবং তাদের মতো অন্য পরিবারগুলোর জন্য বিশেষ করে ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ ও অপ্রত্যাশিত খরচের পরিণতি হচ্ছে অপর্যাপ্ত চিকিৎসা, কোনও চিকিৎসা না হওয়া বা উচ্চ খরচের বোঝার চাপে আরও দরিদ্র হয়ে যাওয়া। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্যব্যয়ের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবার খরচ বহন করতে গিয়ে প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সাধ্যের মধ্যে আনার উপায়
শ্যামপুর ‘আলো’ ক্লিনিক হলো বাংলাদেশের শহর অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে মডেল হিসেবে খোলা ছয়টি শহুরে ক্লিনিকের একটি। এই মডেলের মাধ্যমে সুইডেন সরকারের সহায়তায় এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউনিসেফ মাতৃ ও নবজাতকের যত্ন, শিশুস্বাস্থ্য ও টিকাদান, কিশোরী স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসার মতো সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার একটি অপরিহার্য প্যাকেজ চালু করেছে। কেউ কোন জটিল সমস্যা নিয়ে আসলে কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে যেতে নির্দেশ করা হয়।

পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক এবং গৃহকর্মীসহ কম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা জনগোষ্ঠীর লোকজন যাতে সহজে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য সুবিধজনক স্থানে গড়ে তোলা আলো ক্লিনিকগুলো সপ্তাহে ছয় দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিটি শিফটে পুরুষ ও নারী চিকিৎসক থাকেন। সাধারণ ক্লিনিকগুলো সপ্তাহে মাত্র পাঁচ দিন খোলা থাকে এবং দুপুর ২টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার আগেও বন্ধ হয়ে যায়।
আলো ক্লিনিকে যখন একজন রোগী আসেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক লক্ষণগুলো পরীক্ষা করার আগে তাদের নাম ও ফোন নম্বর নিবন্ধন করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফল দ্রুত একটি অনলাইন ব্যবস্থায় হালনাগাদ করা হয়, যা কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখেন। যেকোনো ল্যাব টেস্ট, স্ক্যান ও প্রেসক্রিপশনও রোগীর ফাইলে সংযুক্ত করা হয়। এই ডিজিটাল ফাইলিং ব্যবস্থা রোগীর তথ্য ও চিকিৎসার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। এটি অপেক্ষার সময় কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের সময় বাড়িয়ে একটি ঝামেলাবিহীন ও দক্ষ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে।
চিকিৎসা পাওয়া রোগীর সংখ্যা এবং যেসব সেবা দেয়া হয়েছে তার উপাত্ত সরকারের ডিজিটাল স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক আপলোড করা হয়। এটি দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা, সম্পদ বরাদ্দ এবং চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নিরীক্ষণের মাধ্যমে ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। চিকিৎসা নেওয়ার পর রোগীরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানান, যা 'আলো' ক্লিনিকগুলোতে সেবার মান উন্নয়নে নিয়মিত বিশ্লেষণ করা হয়।
ক্লিনিকগুলো আশেপাশের বস্তিতে ভ্রাম্যমাণ সেবা কার্যক্রমও পরিচালনা করে। স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য প্রদানের জন্য প্যারামেডিকের দুটি দল কমিউনিটিতে যায়।
‘আলো’ ক্লিনিকগুলো সুলাইমানের মতো শিশুদের শৈশবকালীন সাধারণ অসুস্থতাকে পরাজিত করে তাদেরকে বেড়ে উঠতে সহায়তা করছে, যা না হলে তাদের পরিণতি মারাত্মক হতে পারতো। সুলাইমান যদি মাত্র দেড় বছর আগে জন্মগ্রহণ করতো, তাহলে সে এখন যে মানের চিকিৎসা পাচ্ছে তা হয়তো পেত না, এবং পেতে হলে তার বাবা-মা উচ্চ চিকিৎসার খরচ দিতে বাধ্য হতো।
‘স্বাস্থ্যসেবার পেছনে বিনিয়োগ করা শিশুদের জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে । এই শহুরে ক্লিনিকগুলো ব্যবহারযোগ্য ও সাধ্যের মধ্যে থাকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার পথ প্রদর্শন করে। আমাদের লক্ষ্য হলো, স্বাস্থ্যসেবার পেছনে বর্ধিত ও কার্যকর সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে এই মডেল সম্প্রসারিত হতে দেখা,’ বলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট।