তাঁবুভিত্তিক সেবা প্রদানকারী কেন্দ্রগুলো কোভিড-১৯ কালে পথশিশুদের জীবন রক্ষায় কাজ করছে

যে শিশুরা নিজেরাই নিজেদেরকে রক্ষার দায়িত্ব নেয়, ইউনিসেফের মহামারীকালীন জরুরি কেন্দ্রগুলোতে তারা খাবার, আশ্রয়, খেলা এবং কাউন্সেলিং এর সুযোগ পাচ্ছে

ইউনিসেফ
A boy showing off his art work
ইউনিসেফ/ইউএন০৫২৩৬৫৪/মনির
26 জানুয়ারি 2022

রাফির অনেক হয়েছে। সৎ মায়ের দ্বারা বার বার মারধরের শিকার হওয়ার পর, রাফি তার দাদির কাছে পালিয়ে যায়। কিন্তু তার কাছে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, রাফির দাদি তাদের দুজনকে খাওয়ানোর জন্য রীতিমতো লড়াই করছে, তখন রাফি বরিশালে তার বাড়ি ছেড়ে একটি স্টিমবোটে চড়ে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। রাফির ঢাকার আসার পেছনে মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধান। কারণ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ঢাকাতেই বেশি।

২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রাফি যখন একাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে পৌঁছায়, সে কোথায় থাকবে এবং কি খাবে তখন এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। রাফি জানায়, “আমার সাথে একটি ছাতা ও একটি মোবাইল ফোন ছিল। সেগুলো বিক্রি করে আমি আমার খাবার কিনতে পেরেছি। আমার জুতা না থাকায় একজন আমাকে জুতা কিনে দিয়েছিলেন।”

১১ বছর বয়সী রাফি শীঘ্রই ঢাকার ব্যস্ত নদীবন্দরে কয়েক টাকার বিনিময়ে মানুষের জিনিসপত্র বহনের কাজ খুঁজে পায়। এরপর মহামারী শুরুর পর থেকে সে প্রতিদিন ঢাকায় আসা এবং ঢাকা থেকে ফিরে যাওয়া হাজার হাজার যাত্রীর কাছে মাস্ক বিক্রি শুরু করে।

বন্দরের উপরে এবং নিচে প্রতিদিন ১২ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে উঠা নামা ও কাজ করে রফি মাত্র দুই ডলার সমমানের টাকা (আনুমানিক ১৭০-১৮০ টাকা) আয় করে।

কিন্তু ২০২০ সালে লকডাউনের সময় যখন দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা চলছিল এবং প্রায় দুই মাস ধরে বোট টার্মিনাল বন্ধ ছিল, তখন রাফি কিছুই উপার্জন করতে পারেনি। ইউনিসেফ সমর্থিত শিশু সুরক্ষা পরিষেবা কেন্দ্রের একটি বিশাল তাঁবুর মধ্যে না আসার আগ পর্যন্ত রাফি রাস্তায় বসবাসরত শিশুদের জন্য এনজিওদের দেওয়া খাবার খেয়ে বেঁচে ছিল।

A boy selling masks
ইউনিসেফ/ইউএন০৫৭৪৩৮৯/মাওয়া
ঢাকার একটি ব্যস্ত নৌ টার্মিনালে রাফি মাস্ক বিক্রি করছে।

অসহায় শিশুদের বাঁচার অবলম্বন

ইউনিসেফ বাংলাদেশে এমন ১২টি কেন্দ্রকে সহায়তা দিচ্ছে। কেন্দ্রগুলো শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দিচ্ছে। এছাড়াও শিশুদের বিশ্রাম নেয়া, গোসল করা, লেখাপড়া করা এবং তাদের সহকর্মীদের সাথে খেলার একটি নিরাপদ স্থান হিসাবে এসব কেন্দ্র কাজ করছে।

এর মধ্যে তিনটি জরুরি সেবা কেন্দ্র ঢাকায় অবস্থিত। এখানে তাঁবুতে তারা শিশুদের সেবা দেয়। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশুকে সেবা দেয়া হয়। এছাড়াও প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতি রাতে ১৫ থেকে ২০ জন শিশুর নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

Boys studying
ইউনিসেফ/ইউএন০৫৭৪৩৯৩/মাওয়া
ইউনিসেফ সমর্থিত তাঁবু-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা জরুরি পরিষেবা কেন্দ্রে রাফি তার শিক্ষক মনজুর সাথে পড়াশোনা করছে।

পারিবারিক ভাঙ্গন থেকে বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা রাফির মতো শিশুদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাউন্সেলিং বা প্রয়োজনীয় মনসামাজিক পরামর্শ সহায়তাও দেওয়া হয় এসব কেন্দ্রে। শেষ পর্যন্ত এধরনের শিশুদের তাদের নিজেদের পরিবারে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সমাজকর্মীরা এসব শিশুদের পরিবারের সাথে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্যও কাজ করে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলি বলেন, “ঘুমানোর জায়গা নেই কিংবা মহামারীর ফলে দারিদ্রের গভীরে তলিয়ে গেছে এমন শত শত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের জন্য এই তাঁবু-ভিত্তিক পরিষেবা কেন্দ্রগুলো জীবন রক্ষাকারী হিসাবে কাজ করে।”

শিশু সুরক্ষা জরুরি পরিষেবা কেন্দ্রে আসার পর থেকে রাফির সমাজকর্মী রাফির মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। রাফির মানসিক যন্ত্রনা কমে গেছে এবং এখন সে আর আগের মতো ততটা হতাশাগ্রস্তও নয়। রাফি বরং এখন তার প্রিয় দাদির সাথে পুনরায় মিলিত হওয়ার জন্য বরিশালে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে।

A tent based service center for children
ইউনিসেফ/ইউএন০৩৯২০১৫ / সেতু
কমলাপুর জরুরীশিশু সুরক্ষা পরিষেবা কেন্দ্রের হাব রাস্তায় বসবাসকারী প্রায় পঞ্চাশ শিশুর জন্য তাঁবু-ভিত্তিক আবাসন সহায়তা প্রদান করে।

ইউনিসেফ সমর্থিত তাঁবু-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা জরুরি পরিষেবা কেন্দ্রে সহযাগিতা পেয়েছে এমন আর একজন শিশু হলো ইমরান হোসেন।

পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলে হিসেবে ১১ বছর বয়সী ইমরান ঢাকার সায়েদাবাদের ঘনবসতিপূর্ণ ওয়াসা কলোনিতে বসবাসকারী তার বাবা-মা এবং ছোট ভাইদের সাহায্য করার জন্য সবসময় চেষ্টা করছে। মহামারীর আগে গৃহকর্মী হিসাবে ইমরানের মা এবং রিকশাচালক হিসাবে তার বাবা প্রতিদিন যে অল্প কিছু টাকা উপার্জন করতেন তাতেই তারা খেয়ে পড়ে বেঁচে ছিল। স্কুল ছুটির পরে একটি কাগজ রিসাইকেল করার দোকানে কাজ করে ইমরানও কিছু উপার্জন করতো। কিন্তু মহামারী শুরুর পর থেকে তাদের আর কোন আয় ছিল না।

ইমরান জানায়, “লকডাউনের আগে একটা স্কুলে পড়তাম। লকডাউন শুরু হলে আমার পরিবারকে গ্রামে চলে যেতে হয়। আমার বাবাও অসুস্থ ছিলেন। তাই আমার পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য আমাকে আবার কাজ শুরু করতে হয়েছিল।”

A boy working
ইউনিসেফ/ইউএন০৫৭৪৪১৭/মাওয়া
মহামারী চলাকালীন তার পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য ১১ বছর বয়সী ইমরান ঢাকার একটি কাগজ রিসাইকেল করার দোকানে কাগজের প্যাকেট তৈরি করছে।

মহামারীর কারণে পরিবার সংকটের মুখে

প্রাথমিকভাবে, ইমরান তার পরিবারের সাথে ঢাকা থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার উত্তরে নেত্রকোনায় তাদের গ্রামে ফিরে আসে। তবে যখন ইমরান নিশ্চিত হয় যে, তার পরিবার সেখানেও জীবিকা অর্জন করতে পারবে না, তখনই ইমরান আবার রাজধানীতে ফিরে আসে।

ইউনিসেফের জরুরি শিশু সুরক্ষা পরিষেবা কেন্দ্রগুলোর একটিতে ভাগ্যক্রমে ইমরান নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হয়। খাবার এবং বাসস্থান ছাড়াও, এই কেন্দ্রে ইমরান তার সুস্থতার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, জীবন দক্ষতা সেশন এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপগুলো পেতে সক্ষম হয়েছিল।

ঢাকায় দুই মাস একা থাকার পর, ইমরান তার বাবা-মাকে আবার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। অবশেষে একজন সমাজকর্মী ইমরানকে তার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। এতে ইমরান অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল।

লকডাউন শেষ হওয়ার পর ইমরান ও তার পরিবার আবার ওয়াসা কলোনিতে চলে আসে। যদিও ইমরান আর পরিষেবা কেন্দ্রে ফিরে যায়নি, তবে একজন সমাজকর্মী তার পরিস্থিতির উপর নজর রাখে।

ইমরান জানায়, “আমি বড় হয়ে আমার বাবা-মাকে খুশি রাখতে চাই। আমি যদি লেখাপড়া করতে পারি, আমি আরও ভালো চাকরি পাব এবং আমার বাবা-মায়ের সেবা করব।”

ইউনিসেফ বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা কর্মসূচিতে উদার অবদানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায় ইউনিসেফ। রাস্তায় এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় বসবাসকারী শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের সহযোগিতা করাই এসব কর্মসূচির লক্ষ্য