জেনইউ ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ ২০২২-এ আত্মপ্রত্যয়ী তরুণ উদ্যোক্তারা
তরুণ উদ্যোক্তাদের পরিবেশবান্ধব দেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
অনন্য সব ভাবনা এবং কাজের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের এক অসাধারণ প্রচেষ্টা নিয়ে একদল তরুণ উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি থেকে বিজয়ী দলের সদস্য মারিয়ান তানচাঙ্গা বলেন, “আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানকার উদ্ধাবন সচরাচর সবার চোখে পড়ে না। আমাদের অনেকেই নিজেদের কমিউনিটিকে এমন একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরার সুযোগ পান না। এই প্রতিযোগিতার অংশ হতে পারাটা আমার জন্য জীবন বদলে দেওয়ার মতো একটি অভিজ্ঞতা। এখন আমি আমার ভাবনাগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।”
জাতিসংঘের মহাসচিব ২০১৮ সালের সাধারণ অধিবেশনে জেনারেশন আনলিমিটেড নামের একটি উদ্যোগের উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে এটি ইউনিসেফের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। জেনারেশন আনলিমিটেড হলো বিশ্বের একটি শীর্ষস্থানীয় সরকারি-বেসরকারি-তরুণ পার্টনারশিপ (অংশীদারী)। এর লক্ষ্য বিশ্বের ১৮০ কোটি তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো। আর সেটা করা হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করা, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথকে সুগম করা এবং তরুণদের কাজের মধ্য দিয়ে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে। বাংলাদেশে জেনারেশন আনলিমিটিডের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালে। এর প্রধান উদ্যোগ হিসেবে ২০২২ সালে দেশের ছয়টি বিভাগে চালু করা হয় ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ
জেনারেশন আনলিমিটেড, জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম, এসআইওয়াইবি বাংলাদেশ, টেকনোভেশন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আয়োজনে ‘জেনইউ ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ ২০২২’ মারিয়ানের মতো সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বউদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সক্ষম এমন কার্যকরী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের মেধা প্রদর্শনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট পার্টনারদের (অংশীদারদের) সহায়তা নিয়ে এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ।
তরুণদের নেৃতত্বে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কার্যক্রম
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও চরম আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জেনইউ ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ দেশের সেই সব তরুণদের এক জায়গায় করেছে, যারা এই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলোর সমাধান বের করার জন্য কাজ করছে। ২০২২ সালে দেশের ছয়টি বিভাগজুড়ে সোশাল ইনোভেশন কম্পিটিশন (সামাজিক উদ্ভাবন প্রতিযোগিতা)-এর মধ্য দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। মোট ৬২টি দল এতে অংশ নেয়। এর মধ্যে সেরা উদ্যোগগুলো নিয়ে যাতে পরীক্ষা-নীরিক্ষা এবং সেগুলো আরও উন্নত করা যায় সেজন্য ‘সিড ফান্ড’ ও মেন্টরশিপ সহায়তা দেওয়া হয়।
জাতীয় পর্যায়ের এই আয়োজনে নিজেদের মডেল (প্রটোটাইপ) উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিটি দলের যে অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা ফুটে উঠেছে তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এই তরুণেরা পরিবর্তন ঘটার জন্য অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই পরিবর্তন আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট এসব তরুণ নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। উপস্থাপনায় তুলে ধরা মডেলগুলোর (প্রটোটাইপ) প্রশংসা করে তিনি বলেন, “আপনাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পেরে আমরা নিজেদের খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তার জন্য আমরা আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছি। কারণ উদ্ভাবনী চিন্তা স্যুট পরা পাকা চুলের মানুষের কাছ থেকে আসে না। সেগুলো আসে আপনাদের মতো তরুণদের কাছ থেকে।”
অগ্রগতির দূত
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমানোর অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে প্রতিটি দল তাদের সমাধানগুলো জাতীয় পর্যায়ের এই মঞ্চে উপস্থাপন করে। তরুণদের ব্যতিক্রমধর্মী ১৯টি দলের মধ্যে থেকে দুই দলকে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
ঢাকার ‘বিডি হাইওয়ে টারবাইন’ এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে মহাসড়কে দ্রুতগতির যানবাহন যে বাতাসের চাপ তৈরি করে সেটা ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরি করা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির ‘ক্লাইমেট ক্রু’ লেক ও নদীতে জেঁকে বসা কচুরিপানার সমস্যার সমাধান করেছ একে সারে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে। কচুরিপানার কারণে নৌপথ আটকে মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছিল, বিরূপ প্রভাব পড়ছিল মাছ উৎপাদন ও জেলেদের জীবিকায়। সেগুলোর সমাধানের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ‘ক্লাইমেট ক্রু’ এই কচুরিপানা দিয়ে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব সামগ্রী তৈরীর মাধ্যমে।
এই দুই দলই তাদের মডেলগুলোর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে, যেখানে ৩০টি দেশের মোট ৬০টি দল প্রতিযোগিতা করবে। তার মধ্য থেকে শীর্ষ ১০টি দল বৈশ্বিক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নির্বাচিত হবে। প্রতিটি দলকেই সিড ফান্ড ও মেন্টরশিপ সহায়তা দেওয়া হবে, যেন তারা তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে পারে।
বিজয়ীদের একজন আসাদ খান ইফাত বলেন, “এই প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানার আগে থেকেই আমাদের এই আইডিয়া নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে ছিল। এতে কী ফল আসবে তা নিয়ে না ভেবেই আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। এখন আমরা পরবর্তী ধাপে পৌঁছেছি। আমাদের আইডিয়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা আগের চেয়ে এখন আরও বেশি সংকল্পবদ্ধ।” তাদের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য জেনারেশন আনলিমিটেড যে সহায়তার প্রদান করেছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আসাদ খান।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে ইতিবাচক শক্তি
বাংলাদেশে তরুণদের উদ্যোগগুলোকে তুলে ধরতে জেনইউ ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ অসামান্য অবদান রাখছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে তরুণদের আইডিয়াগুলোকে উৎসাহিত করার জন্য এমন আরও অনেক উদ্যোগের অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করবে জেনইউ ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ।
সমাপনী বক্তব্যে ইউনিসেফ বাংলাদেশের জেনারেশন আনলিমিটেডের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারিয়ানা ওয়েলারস বলেন, “ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ-এর সফলতার মূলে রয়েছে জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের শক্তিশালী পার্টনারশিপ (অংশীদারী) ও সহায়তা। তরুণদের দলগুলো যেন নেটওয়ার্কিং করে, তাদের বক্তব্যগুলো তুলে ধরে এবং নিজেদের কমিউনিটি ও এর বাইরেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে নিজেদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগায় এবং সমবয়সী ও প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে শক্তিশালী যোগাযোগ গড়ে তোলে-সেই পরামর্শ আমি তাদের দিই।”
২০২২ সালের সফলতার পর এবার ইমাজেন ভেঞ্চারস ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ ২০২৩ দেশের আটটি বিভাগে অনুষ্ঠিত হবে। তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি জেন্ডার অসমতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।