গোলটেবিল বৈঠক: ডেঙ্গু নিয়ে শঙ্কাহীন ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফের যৌথভাবে আয়োজিত একটি সংলাপে দেশের বর্তমান গুরুতর ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা জোরদার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যুক্ত করে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়

- বাংলা
- English
এই গুরুতর ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় যারা সরাসরি ভূমিকা রাখছে, সেই সব গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের নিয়ে সম্প্রতি একটি সংলাপ আয়োজনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করে ইউনিসেফ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের প্রতি এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টা জোরদারের আহ্বান জানানো হয়
ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘জনস্বাস্থ্য সংকট’ পর্যায়ে
দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এবার, গত বছরের চেয়ে প্রায় মাসখানেক আগেই প্রাণঘাতী এই রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর রোগ বেশি ছড়াচ্ছে, যাতে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে, ডিজিএইচএস এর তথ্য অনুসারে, প্রতি পাঁচজন রোগীর মধ্যে একজন ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় ডেঙ্গুর সংক্রমণে শিশুরা কতটা অসহায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়ার দরুন মশার বংশবিস্তার, মানুষকে মশা কামড়ানোর হার এবং মশার শরীরে ভাইরাস জীবাণুর উন্মেষ পর্ব (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) – এ সব কিছুই বাড়তে পারে।
মশাবাহিত এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ,যার মধ্যে রয়েছে সচেতনতা তৈরিতে (অ্যাওয়ারনেস) ক্যাম্পেইন, মশার বংশবিস্তারের স্থান নির্মূল ও লাভা নির্ধন। তাছাড়া বয়স ও এলাকা ভিত্তিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী এবং এতে মৃত্যুর তথ্য শ্রেণিবিন্যাস করছে সরকার। দেশজুড়ে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য সব হাসপাতালে আলাদা ইউনিট করা হয়েছে। অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইনের আওতায় সরকারের বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ক্রমাগত ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য প্রচার এবং কীভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়ক প্রচারণা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা প্রাক-বর্ষা, বর্ষাকালীন ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ের জরিপের মতো নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এরপরও, ডেঙ্গু মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গুরুতর এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সকল আলোচকগন ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত জাতীয় কৌশলের কথা বলেন, যা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এছাড়া, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এবং প সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি জোরালো কমিউনিটিকেন্দ্রিক ডেঙ্গু নজরদারির (সারভেইলেন্স) ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দেয়া হয় যার আওতায় স্বল্প সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা যাবে। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তারের স্থান নির্মূলে কমিউনিটির নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণও ডেঙ্গু সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পারে।
জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সঠিক বিনিয়োগ
এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ডেঙ্গুর কবলে পড়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ডেঙ্গু সংক্রমণের সংখ্যার দিক থেকে নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে চলেছে। ইউনিসেফ ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারকে ২২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের জরুরি সহায়তা সামগ্রী দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট, সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের প্রশিক্ষণসহ স্বাস্থ্য, এবং পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও হাইজিন খাতগুলোতে অন্যান্য জরুরি সরঞ্জাম ও সেবা প্রদাণ। ইউনিসেফ এ বিষয়ে ১৫ হাজার ধর্মীয় নেতা, কমিউনিটির প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং কিশোর-কিশোরী ও তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের যুক্ত করছে, যারা নিজ নিজ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ভূমিকা রাখবেন। অংশীজনদের সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কারিগরি পরামর্শ দেবার মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করছে। পাশাপাশি নির্ধারিত এলাকায় মশার বংশবিস্তারের স্থান পরিষ্কার করা এবং জীবন রক্ষাকারী বার্তাসমূহ প্রচারণার কাজেও ইউনিসেফ সহায়তা করছে। এরইমধ্যে এসব বার্তা দেশের পাঁচ কোটির বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেছেন, “চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে আরও কিছু কাজ করতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য, যারা এই ভাইরাস সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ”
ইউনিসেফ বাংলাদেশ এখন তার অগ্রাধিকার তালিকায় ডেঙ্গু মোকাবিলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন শেলডন ইয়েট। তিনি বলেন, “আমাদের সবাইকে একসাথে মিলে ডেঙ্গু সংক্রমণের এই চক্র ভাঙতেই হবে এবং শিশু ও তাদের পরিবারগুলোর জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।”
সম্মিলিত প্রচেষ্টা জোরদারকরণ
বাংলাদেশ যেভাবে কোভিড-১৯ অতিমারি সামাল দিয়েছে, তা যেকোন মহামারি মোকাবিলায় এদেশের সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; যা প্রমাণ করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সময়মত কার্যকরী নির্দেশনা-বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলো ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তগুলোও তুলে ধরা হয় এই গোলটেবিল বৈঠকে।
এ প্রসঙ্গে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন যেভাবে এক্ষেত্রে সফল হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন উৎপত্তিস্থলেই মশা নিধন ও এর বংশবিস্তার রোধ এর লক্ষ্যে, বর্জ্য অপসারণে নতুন কৌশল প্রয়োগ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় বাড়তি গুরুত্ব আরোপ এবং ভাইরাস বাহক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।
এছাড়াও, মানুষের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও ডেঙ্গু সংক্রমণের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আলোচনায় উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা জানান। এর ফলে, আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা করাটাও আরও সহজ হবে বলে তারা মনে করেন। আলোচকেরা সম্মিলিতভাবে আরেকটি বিষয়ে জোর দেন, তা হলো - এই রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলেও কমিউনিটিগুলো এ বিষয়ক পরামর্শসমূহ মেনে চলছে না এবং ডেঙ্গু বিস্তারের কারণগুলো জানা থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সময়মত পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এর মধ্য দিয়ে শুধু উদ্ভাবনী সমাধান আসার পথই খুলবে তা নয়, বরং সকল কমিউনিটি যেন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় তাও নিশ্চিত হবে। এই সংকট মোকাবিলায়, সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় সহায়তা অব্যাহত রাখতে, ইউনিসেফ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।