গর্ব করার মতো একটি টয়লেট
ব্যবসায়িক নৈতিকতা এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী স্যানিটেশন
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
রাতের বেলায় টয়লেটের প্রয়োজনে যখনই ইতির ঘুম ভেঙে যেত, তখনই সে ওই অস্বস্তি সকাল অবধি চেপে রাখতো যাতে টয়লেটে যেতে না হয়। বাংলাদেশের খুলনার সাতক্ষীরা জেলায় তার গ্রামে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ইতি তার মাকে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে পিট ল্যাট্রিনে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করতো।
প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনে ১৬ বছরের ইতি কেবল তখনই নিরাপদ বোধ করতো, যখন তার মা টয়লেটের বাইরে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। টয়লেটটি ছিল পাতলা চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা। টয়লেটের ভেতরের দুর্গন্ধে ইতির বমি আসার উপক্রম হতো, এমনকি সে স্কার্ফ দিয়ে নাক ঢেকে রাখলেও। ইতি সবসময় পিছলে টয়লেটের ভেতরে পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে থাকতো, যেভাবে তার দাদী একবার পড়ে গিয়ে তাঁর পা ভেঙে ফেলেছিলেন।
ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর যখন আরও বেশি বেশি টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হতো, তখন পরিস্থিতি কঠিন আকার ধারণ করতো উল্লেখ করে ইতি বলে, “আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ ল্যাট্রিন নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর ছিল। তাছাড়া, সেগুলো বাড়ি থেকে দূরে। ফলে আমার বয়সী প্রত্যেককেই আমার মতো একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।”
ডায়রিয়া ও আমাশয়ের কারণে স্কুলে যেতে না পারা
বাংলাদেশে স্যানিটেশন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের ঘটনা এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু নিম্নমানের টয়লেট লাখ লাখ বাংলাদেশি শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। ইতির মতো গ্রামীণ এলাকায় মাত্র এক তৃতীয়াংশ পরিবার শিশুর মল নিরাপদে অপসারন করে।
বেশিরভাগ ল্যাট্রিন অনেকে মিলে ভাগাভাগি করে, অনেকগুলো আবার ভাঙা বা নিম্নমানের। অনেকগুলোতে ওয়াটার সিল না থাকায় মল থেকে দুর্গন্ধ তৈরি হয় বা মলে মাছি বসে। এই কারণে, টয়লেটগুলো প্রায়শই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে তৈরি করা হয় এবং শিশু ও নারীদের জন্য সেগুলো প্রায়শই অনিরাপদ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এখানে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় বহু ল্যাট্রিন পানিতে তলিয়ে যায়, নষ্ট হয়। তখন এর উপচে পড়া বর্জ্য, যা রোগজীবাণুতে ভরা, খাবার পানির উৎসকে দূষিত করে এবং রোগের বিস্তার ঘটায়। ওইসব রোগের অনেকগুলোই শিশুদের জন্য প্রাণঘাতী।
নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধির কারণে ডায়রিয়া ও আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে ইতিকে প্রায়ই স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখতে হতো। এজন্যও দায়ী ছিল তাদের পারিবারিক টয়লেটের দুরবস্থা। তার পাঁচ বছর বয়সী ভাইও প্রায়ই রোগে আক্রান্ত হতো। কিন্তু ছয় মাস আগে, তার বাবা, মো. জিয়ারুল সরদার, তাদের ল্যাট্রিনটি সংস্কার ও উন্নত করেছেন। নতুন রিং ও একটি নতুন স্ল্যাব স্থাপন করেছেন, যাতে ওয়াটার সিল রয়েছে। এর পর থেকে পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়নি এবং ইতি তার পড়াশোনা ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে পারছে।
এই কিশোরী বলে, “এখন আমি আগের মতো অসুস্থ হইনা এবং স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখি না। আমি আমার বন্ধু এবং ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে পারি। আমি ঘরের কাজে আমার মাকে সাহায্যও করতে পারি।”
প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন, আয় যাই হোক
ইতির বাবা দীর্ঘদিন তার পরিবারের জন্য নিম্নমানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে ভুগেছেন। তিনি দেখতে পান কীভাবে এটি তার স্ত্রী ও সন্তানদের অসুস্থ করে দিচ্ছিল। কিন্তু একজন দিনমজুর হিসেবে দৈনিক ২০০ টাকা (প্রায় ২.৩০ ডলার) আয় করা জিয়ারুল কীভাবে তার পরিবারের জন্য একটি ভালো ল্যাট্রিন তৈরি করতে পারেন তা ভেবে পেতেন না।
একদিন কাজ খুঁজতে গিয়ে জিয়ারুল ল্যাট্রিন সামগ্রী বিক্রির একটি দোকানে যান। দোকানের মালিক হাফিজুর শত শত উদ্যোক্তার মধ্যে একজন, যারা ২০২৪ সালের মধ্যে ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি পরিবারের স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ইউনিসেফ সহায়তাপুষ্ট একটি প্রকল্পে সম্পৃক্ত। ‘বাংলাদেশে স্যানিটেশন বাজার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি সব শিশু যাতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পায় এবং তাদের পরিবারের আয় যাই হোক না কেন, তারা যাতে টয়লেট বানাতে পারে তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। একটি উপায় হলো, ৫০ ডলার অর্থমূল্যের ভাউচারের আকারে ভর্তুকি প্রদান, যা ৭০ হাজার দরিদ্র পরিবারকে দেওয়া হবে; যাতে তারা দুই পিট বা গর্তের একটি টয়লেট বানাতে এই অর্থ কাজে লাগাতে পারে।
প্রকল্পে একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে হাফিজুর বিভিন্ন ধরনের উন্নত ল্যাট্রিন, কীভাবে যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হয় এবং কীভাবে বেসরকারি কোম্পানিগুলো থেকে উপকরণ সংগ্রহ করতে হয় সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তিনি হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকদের সেবা প্রদান, বিক্রি বাড়ানোর কৌশল এবং গ্রাহকদের মাঝে ভালো স্বাস্থ্যবিধির চর্চা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির গুরুত্ব সম্পর্কেও শিখেছেন।
সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে হাফিজুর নতুন ল্যাট্রিন সামগ্রী কেনার জন্য জিয়ারুলকে রাজি করান, যার দাম তিনি কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারেন। তিনি জিয়ারুলকে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার উপকারিতাও ব্যাখ্যা করেন। মোটকথা, জিয়ারুল টয়লেট রিং, পাইপ ও নতুন একটি স্ল্যাব কেনার পেছনে ৩ হাজার ৩০০ টাকা (প্রায় ৪০ ডলার) ব্যয় করেন।
হাফিজুর বলেন, “প্রাথমিক পর্যায়ের ল্যাট্রিনটি সাধারণ পরিবার এবং যাদের সক্ষমতা ও জমি কম তাদের জন্য বেশি উপযোগী হবে। ওই পরিবারগুলো সহজেই এই ল্যাট্রিন স্থাপন করতে পারে। এই ধরনের ল্যাট্রিন নিশ্চিত করে যে, গর্তের সঙ্গে সংযোগকারী পাইপের মাধ্যমে মল আরও নিরাপদে অপসারন করা যেতে পারে।”
“এটি খুবই কার্যকর, কারণ এটি একটি পরিবারের জন্য দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়”, তিনি যোগ করেন।
ল্যাট্রিনে বিনিয়োগ মানে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ
২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশে ৩ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ উন্নত টয়লেট সামগ্রী কিনেছে এবং এটি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। ১ হাজার ৩০০ ল্যাট্রিন উদ্যোক্তা স্যানিটেশন বাজার ব্যবস্থা প্রকল্পের অংশ হিসেবে উন্নত ল্যাট্রিন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিনের সেকশনের প্রধান জাইদ জুরজি বলেন, “পরিচ্ছন্ন, সচল টয়লেট শিশুদের স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। ভালো স্যানিটেশন মানে, শিশুরা স্কুলে থাকতে পারবে এবং অভিভাবকরা চিকিৎসার পেছনে কম খরচ করবেন। একই সঙ্গে মেয়েদের নিরাপত্তা এবং মর্যাদাও উন্নত হবে।”
জিয়ারুল গর্বিত যে, একটি উন্নতমানের টয়লেটের পেছনে বিনিয়োগ তার স্ত্রী ও সন্তানদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকার বয়ে এনেছে। ভালো স্বাস্থ্যবিধির চর্চার জন্য পীড়াপীড়িও তার নিজের পরিবারকে সহায়তা করেছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে যা আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ''এখন সবাই ল্যাট্রিন ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়, তাই আগের তুলনায় রোগবালাই অনেক কম। আমার মেয়েও এখন ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারে। আমি ঠিকমতো কাজ করতে পারি। আমার স্ত্রী অসুস্থ নয় এবং ছোট ছেলেটি কষ্ট পাচ্ছে না।”
ইতি আনন্দিত যে, তাকে এখন আর টয়লেট ব্যবহার করার জন্য দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয় না। কারণ এটি এখন তার বসবাসের ঘরের কাছাকাছিই স্থানান্তরিত হয়েছে এবং সে এখন অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করে।
ইতি বলে, “ল্যাট্রিন অবশ্যই বাড়ির কাছাকাছি হতে হবে, যাতে ল্যাট্রিনে যেতে কোনো ভয় বা দ্বিধা না কাজ করে, বিশেষ করে ঋতুস্রাবের সময়।”