"এখন আমি পা দিয়ে লিখি, আমার চেনাজানা আর কেউ এটা পারে না"
মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় দুই হাত হারালেও পা দিয়ে লিখে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে ১৪ বছরের এহসান

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
রোহিঙ্গা শিবিরে গত ৩১ মে প্রথমবারের মতো বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা দেয় ১৪ বছর বয়সী এহসান। তবে তাঁর এই পরীক্ষা অন্য সহপাঠীদের মতো ছিল না। এহসান হাতের বদলে ডান পা দিয়ে কলম ধরে লিখে পুরো পরীক্ষা দেয়।
এক বছর আগে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় দুই হাত হারায় এহসান। এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলার সময় বিদ্যুতের তার এসে তাদের ওপর পড়ে। এহসান ও তার দুই বন্ধু বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়। এহসান ও এক বন্ধু প্রাণে বেঁচে গেলেও অপরজন মারা যায়। কিন্তু জীবন বাঁচাতে এহসানের দুই হাত কেটে ফেলতে হয়।
অস্ত্রোপচারের পর দুই মাস এহসানকে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো জীবনযাপন করতে হয়। সে হাঁটতে পারত না, এমনকি নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতেও পারত না। সে ভেবেছিল, এই দুর্ঘটনায় তার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। এহসান সব সময় তার পড়াশোনা শেষ করতে চেয়েছিল।
এহসান বলে, “আমি যখন মিয়ানমারে ছিলাম তখন একটি স্কুলে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছিলাম। তারপর আর স্কুলে যেতে পারতাম না। এর পরপরই ঘরবাড়ি ছেড়ে আমরা বাংলাদেশে চলে আসি।”
প্রায় ছয় বছর আাগে এহসান ও তার পরিবার নিজেদের দেশ মিয়ানমারে সহিংসতা ও নির্যাতনের মুখে পালাতে বাধ্য হয়। তারপর থেকে তারা বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে।
শেখার অদম্য ইচ্ছা
আশ্রয় শিবিরে অবস্থানকালে এহসান নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে। সে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। একজন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছেও পড়তে থাকে। ইউনিসেফ যখন গত বছর শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পড়াশোনা চালু করে, তখন এহসান ইউনিসেফ পরিচালিত একটি শিক্ষাকেন্দ্রেও ভর্তি হয়।
সেই স্মৃতি মনে করে এহসান বলে, “নতুন পাঠ্যক্রমে ক্লাস শুরুর বিষয়ে আমি দারুণ উত্তেজনায় ছিলা কারণ এই বিষয়গুলো আমরা দেশে পড়ে এসেছি। মনে হচ্ছিল যেন নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছি। আমার মনে হচ্ছিল, এখানে আমি আমার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে পড়াশোনা করতে পারব।”
দুর্ঘটনাটির পর এহসানের এই আশা প্রায় পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরিবার ও শরণার্থী শিবিরের সেবাদাতাদের যত্ন ও পরিচর্যায় দুর্ঘটনার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে শুরু করে এহসান। ইউনিসেফের কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হিউম্যানিটি অ্যান্ড ইনক্লুশনের (এইচআই) একজন ফিজিওথেরাপিস্ট প্রতিদিন এহসানের বাড়িতে গিয়ে তার দুই পায়ে থেরাপি দেন। ধীরে ধীরে এহসান হাঁটাচলার শক্তি ফিরে পায়।
স্কুলে ফেরা
এহসান বলে, “আমি আবার যখন হাঁটতে শুরু করলাম, এর সাথে সাথেই আমি জানতাম আমি আবার আমার শিক্ষাকেন্দ্রে ফিরে যেতে চাই। আমার শিক্ষক আমাকে দেখতে এলেন এবং হেঁটে শিক্ষা কেন্দ্রে যেতে আমাকে সহযোগিতা করলেন। এমনকি কীভাবে পা দিয়ে লিখতে হয়, সেটা শিখতে তিনি আমাকে সহযোগিতা করলেন। পা দিয়ে লিখতে শেখা অনেক দীর্ঘ সময় নেয় এবং অনেক কষ্টকরও ছিল। কখনো কখনো বিব্রতকরও হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন আমি আমার পা দিয়ে লিখি। আমার চেনাজানা আর কেউ এটা পারে না।’
এহসান আবার তার স্বপ্ন পূরণের আশা করে। তাঁর বাবাও অনেক খুশি হয়।
এহসানের বাবা কামাল বলেন, “আমার ছেলে যখন দুই হাত হারাল তখন আমার আমি একদম ভেঙে পড়েছিলাম। আমি সব সময় তাকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতাম। আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান। এহসান যাতে দু্র্ঘটনার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য আমার পরিবারের প্রতি যে সহায়তার হাত বাড়ানো হয়েছে, তাতে আমি কৃতজ্ঞ।’
এহসান বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, শিগগিরই সে সপ্তম শ্রেণিতে উঠবে। সে তার ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের একজন।
ইউনিসেফ ও অংশীদাররা বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নতুন বছরের পাঠ্যক্রম তৈরি করছে। এহসানের মতো শরণার্থী শিবিরের আরও দেড় হাজারের বেশি প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষায় সহায়তা প্রদান একটি প্রধান লক্ষ্য।