এক বছরে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকাদানের হার বেড়েছে

করোনার টিকা পাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি দেশ কীভাবে সফল হল

ইউনিসেফ
A Bangladeshi COVID-19 vaccinated woman.
UNICEF/UN0413749/Mawa
08 জুন 2022

কোভিড-১৯ টিকা যখন বাংলাদেশে আসতে শুরু করে মানুষ তখন আশাবাদী হয়ে উঠে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব আবার মিলিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে । জীবনটা আরও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। স্কুল খুলবে সেই আশাও জেগে উঠে আবার।

মহামারি বাংলাদেশে শিশুদের জন্য যতটা সংকট নিয়ে এসেছে, অন্য কারও জন্য তা আনেনি। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণ ব্যাহত হয়েছে। দেশের প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ শিশু ১৮ মাসের মতো সশরীরে ক্লাসে যোগ দিতে পারেনি। এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশে দ্রুত গতিতে টিকা দেওয়া হয়েছে। আর এটার পেছনে কোভিড-১৯ টিকা সরবরাহের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

COVID-19 vaccines consignment in Bangladesh
UNICEF/UN0471113/Chakma

কোভ্যাক্সের আওতায় কোভিড-১৯ টিকা প্রথম বাংলাদেশে এসেছিল এক বছর আগে। কোভ্যাক্স হলো ইউনিসেফ ও এর অংশীদারদের নেতৃত্বাধীন একটি যুগান্তকারী বৈশ্বিক উদ্যোগ, যারা বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ টিকা সমানভাবে সরবরাহের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঢাকায় এসব টিকা আসতে শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশই কোভ্যাক্সের আওতায় সবচেয়ে বেশি টিকাপ্রাপ্ত দেশ হয়ে উঠেছে।

২০২১ সালের জুনের শুরুর দিকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশের কম মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছিল। এক বছরের মাথায় সেই সংখ্যা এখন ৬৮ শতাংশের বেশি।

এই অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও উন্নয়ন অংশীদারদের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও বিপুল পরিশ্রমের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।

সাড়ে ১১ কোটি মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ

সারা দেশে সামনের কাতারের স্বাস্থ্যকর্মীরা শহরাঞ্চলের বস্তি ছাড়াও মাঠঘাট ও নদী পাড়ি দিয়ে মানুষকে টিকা দিয়েছে। এই প্রচেষ্টার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ। ইতোমধ্যে দেশে ২৫ কোটির বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। সাড়ে ১১ কোটির বেশি মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছে।

মোহাম্মদ আল মামুনের মতো তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলায় মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের নিবন্ধন করিয়েছে মামুন।

কোভিড-১৯ টিকা নিতে একজনের ক্লিনিকে যাওয়ার পথে সঙ্গ দিচ্ছেন ইউনিসেফের স্বেচ্ছাসেবক মাহমুদা নাসরিন মুক্তা।
UNICEF/UN0537608/Kiron
কোভিড-১৯ টিকা নিতে একজনের ক্লিনিকে যাওয়ার পথে সঙ্গ দিচ্ছেন ইউনিসেফের স্বেচ্ছাসেবক মাহমুদা নাসরিন মুক্তা।

কোভিড-১৯ টিকা নিরাপদ এবং এটা সহজে পাওয়া যায়, এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে ঢাকার ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মাহমুদা নাসরিন মুক্তা।

মুক্তা বলেন, “আমি অনেক অসহায় মানুষকে দেখেছি। মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করাটা আমি উপভোগ করেছি। তাঁদের সহযোগিতা করতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে।”

বাংলাদেশে টিকাদানের হার বৃদ্ধি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একটি বড় স্বস্তি নিয়ে এসেছে।

ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালের সহকারী সার্জন নওরিন জাহান বলেন, ‘যখন মহামারি শুরু হল সেই সময় ভাইরাসটি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমরা সত্যিই ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব পালন থেকে একটুও সরে আসিনি।” বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রথমে যারা কোভিড-১৯ টিকা নিয়েছিল তাদের একজন নওরিন।

টিকা নেওয়ার পর নওরিন জাহান বলেন, “টিকা এসে গেছে। এখন কোনো ভয় ছাড়াই আমরা কাজ করতে পারবো। আমাদের অন্ধকারের দিনগুলোর বিদায় নেওয়ার পালা শুরু হয়েছে।”

A group of vaccinated women.
UNICEF/UN0413740/Mawa

টিকাদানের মূল লক্ষ্য নাগালের মধ্যে

গণ টিকাদান কর্মসূচি বিশেষ করে হাম ও রুবেলার মতো রোগের টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অতীতের ভালো রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে মানুষকে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়াটা বিশেষ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে

কোভিড-১৯ টিকা যখন প্রথম তৈরি করা হয় এবং বাজারে আসতে শুরু করে, সে সময় ধনী দেশগুলো অধিকাংশ টিকা কিনে নেয় । তখন বিশ্বের নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য খুব অল্প টিকা অবশিষ্ট ছিল, যা দিয়ে এই চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। টিকা নিয়ে এই সংকটের ফলশ্রুতিতে কিছু দেশে কম অগ্রাধিকারের ব্যক্তিরা আগেভাগে টিকা নিতে শুরু করে। যেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ব্যক্তি ও অসহায় গ্রুপগুলো টিকা পাচ্ছিল না।

২০২১ সালের জুন থেকে আগস্ট সময়কালে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউ চলে, যা ছিল বিপর্যয়কর। সে সময় কোভ্যাক্সের আওতায় দেশে কিছু টিকা আসতে শুরু করলেও সেগুলো বিতরণে সময় লেগে যায়।

“ইউনিসেফ ও শক্তিশালী অংশীদারিত্বকে ধন্যবাদ। আমরা শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে কোভ্যাক্সের আওতায় যথেষ্ট পরিমাণে টিকা পেয়েছি। দেশজুড়ে টিকা পৌঁছানোর জন্য কোল্ড চেইন তৈরি এবং মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সরকারকে সহায়তা করেছি,” বলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের হেলথ্‌স্পেশালিস্ট ও ইম্যুনাইজেশন লিড ডা. মেরিনা অধিকারী।

কোভিড-১৯ টিকা দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
UNICEF/UN0626831/Matwa
কোভিড-১৯ টিকা দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই এলাকাতেই অনেক জায়গায় পৌঁছানো এখনও খুবই কষ্টসাধ্য।

পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা পাওয়ার পরে টিকাদানের হার বাড়ানোর লক্ষ্যে সেসময় সরকার ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য অংশীদারদের সহযোগিতায় গণটিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে কয়েক দিনের মধ্যে কোটি মানুষকে টিকা দিতে সক্ষম হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই ক্যাম্পেইনের আওতায়  এক কোটি ৭০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়।

এরপর ওই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে মার্চে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয়। এসব প্রচেষ্টার ফলে চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে বাংলাদেশে টিকা দানের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কমিউনিটি টিকাদান কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে কোভিড-১৯ টিকা।
UNICEF/UN0468104/Mawa
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কমিউনিটি টিকাদান কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে কোভিড-১৯ টিকা।

সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে

বাংলাদেশে আরও লাখ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে। সে কারণে এবিষয়ে দেশের সামনে কতগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

দেশের সকল মানুষ, বিশেষ করে বয়স্ক ও অধিকতর অসহায় মানুষের কাছে টিকা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে এখনও ৬০ বছর ও তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের প্রায় ৬০ শতাংশকে টিকা নেয়নি। কখন কোথায় টিকা পেতে পারে, সে বিষয়ে তাদের কাছে তথ্য নেই। এ সকল ব্যক্তি ও অন্যান্য যারা এখনও টিকা নেননি তাদের কাছে পৌঁছাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের এসব সুনির্দিষ্ট কমিউনিটিতে বিশেষ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে।   

এমনিতেই চাপের মুখে থাকা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় কোভিড-১৯ এর কারণে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা ও মানুষকে টিকাদানে সহযোগিতার পাশাপাশি বহু স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র এখনও মহামারি শুরুর আগে থেকে বিদ্যমান রোগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

ময়মনসিংহ জেলায় কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে নদী পার হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
UNICEF/UN0468122/Mawa
ময়মনসিংহ জেলায় কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে নদী পার হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ এর টিকা পৌঁছানোর এক বছর পূর্তির এই সময়ে সামনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রতিটি কমিউনিটিতে যেন টিকা পৌঁছায় তা নিশ্চিত করা। 

ইউনিসেফ বাংলাদেশের হেলথ্‌ সেকশনের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, ‘ইউনিসেফ গর্বের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের টিকাদানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কাউকে পেছনে না রেখে লক্ষ্য অর্জনে অংশীদারদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করার ওপরই আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।’