একটি প্রজন্মের কন্ঠস্বর
রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীরা তাদের কমিউনিটিকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আশার সঞ্চার করছে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলা সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসে ৮ লক্ষ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে থাকতে বাধ্য হয়েছে। এসব শরণার্থীদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী। কক্সবাজারে বসতি স্থাপন করে এসব শরণার্থীদের কেউ কেউ আশ্রয়শিবিরে বাস করছে। আবার এদের অনেকেই স্বাগতিক বাংলাদেশী কমিউনিটির আশ্রয়ে রয়েছে।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না থাকা এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে নিজেদের পরিচয় প্রকাশের যথাযথ জায়গা এবং সুযোগ না থাকায় এসব শরণার্থী শিশুদের অনেকেই একটি হারানো প্রজন্মের অংশ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
নিজেদের পড়াশুনা, লেখালেখি, খেলাধুলা এবং সৃজনশীল দিকগুলো বিকশিত করার স্বাধীনতা রয়েছে তাদের জন্য এমন নিরাপদ জায়গা করে দেওয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীদের কবিতা এবং আঁকা ছবিগুলো নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের স্বপ্ন ও আশাকেই চিত্রিত করে।
কিশোর-কিশোরিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এসব উদ্বেগ নিরসনের লক্ষে ইউনিসেফ রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় কমিউনিটির কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন বিকাশ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েকটি সামাজিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে সামাজিক সংহতি উৎসাহিত করাও সামাজিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য। সামাজিক কেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়া করে এমন রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীদের কবিতা এবং ছবি এখানে নির্বাচিত করা হয়েছে যা মূলত নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের আশা-আকাঙ্খাকে প্রতিফলিত করে।
ওমর, বয়স ১৬ বছর
রোহিঙ্গা কমিউনিটি

শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত ১৬ বছর বয়সী ওমর তার বাড়ির নিকটবর্তী একটি সামাজিক কেন্দ্রের নিয়মিত সদস্য। গল্পের বই পড়া এবং লেখালেখি করার মাধ্যমে সামাজিক কেন্দ্রে ওমর তার অবসর সময় কাটাতে পছন্দ করে। ওমর প্রায়শই কবিতা লেখে। শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে তার তিন বছরের অভিজ্ঞতাগুলোই এসব কবিতায় প্রতিফলিত হয়।
স্বদেশ থেকে পালিয়ে এসেছি
আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই
ঘরে ফেরার পথ অস্পষ্ট হয়ে হয়ে যাচ্ছে
দেখার মতো মুখ নেই
বলার কোন কথা নেই
খেলার কোন জায়গা নেই
মানুষ মানুষকে সাহায্য করেছিল
লক্ষ লক্ষ ধন্যবাদ যথেষ্ট নয়
কোটি কোটি প্রার্থনা যথেষ্ট নয়
কোন দাঁড়/বৈঠা নেই
কোন তীর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না
গণনাহীন সাহায্যের হাত
আমাকে তীরে নিয়ে গেল
এখন আমার আশ্রয় আছে
স্বাগত জানানোর হাসি ভরা মুখ আছে
বলার অনেক কথা আছে
লেখার কলম আছে
গাওয়ার মতো গান আছে
আমি এখন খেলোয়াড় জেনারেল
ঘরে ফেরার পথ আরও উজ্জ্বল হচ্ছে

ওমর জানায়, “আমরা যখন বাংলাদেশে আসি তখন আমি আমার সবগুলো বই হারিয়ে ফেলেছিলাম। দীর্ঘ সময় আমি কোন কিছু পড়তে পারিনি।” ওমর আরও জানায়, “এই জায়গাটিতে একটি লাইব্রেরী আছে এটা জানার পর আমি যখন এখানে না এসে থাকতে পারিনি। যতটা সময় সম্ভব আমি এখন লাইব্রেরীতেই কাটাই।”
হোসেন, বয়স ১৭ বছর
বাংলাদেশী কমিউনিটি

স্কুল থেকে স্নাতক হয়ে বের হওয়ার পরে পেশা হিসাবে হোসেন শিল্পকলাকেই বেছে নিতে চায়। সামাজিক কেন্দ্রে এসে সে প্রতিদিন ছবি আঁকার অনুশীলন করে। কারন, ছবি আঁকার মাধ্যমে সে শান্তি খুঁজে পায়। ছবি আঁকার দক্ষতার কারনেই ভবিষ্যত নিয়ে সে বড় স্বপ্ন দেখে।
হোসেন জানায়, “একদিন আমি একটি আর্ট স্কুল খুলতে চাই যেখানে আমি অন্য শিশুদেরকে আমি শখের আঁকা শেখাতে পারি। সে যেই হোক না কেন, আমি মনে করি ছবি আঁকা প্রত্যেকের জন্যই একটি ভাল অভ্যাস।”

ইয়াসিনা, বয়স ১৫ বছর
বাংলাদেশী কমিউনিটি

সামাজিক কেন্দ্রের ১৫ বছর বয়সী বাংলাদেশী সদস্য ইয়াসিনা গত এক বছরে রোহিঙ্গা কমিউনিটির মেয়েদের সাথে দ্রুত বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। তারা প্রায়শই তাদের জীবন নিয়ে গল্প বিনিময় করে।
ইয়াসিনার মতো সহজে বিশ্বাস করা যায় এমন কাউকে পেয়ে রোহিঙ্গা কিশোরীরা তাদের লড়াই এবং প্রতিদিন কীভাবে তারা তাদের দেশকে মিস করছে সেই কষ্টের গল্প বলে।
ইয়াসিনা জানায়, “আমার বন্ধুরা কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে সম্পর্কে আমি জানি।” ইয়াসিনা আরও জানায়, “তাদের মানুষজন অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। একদিনের জন্যও বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারি আমি এটা কল্পনাও পারিনা। কিন্তু তিন বছর ধরে তারা তাদের ঘরবাড়ি থেকে দূরে রয়েছে। এটা ভাবতেও খুব কষ্ট হয়।”
সামাজিক কেন্দ্রে এতোদিনে তৈরি হওয়া সখ্যতার কারণে ইয়াসিনার মধ্যে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সংহতিতে অবদান রাখার সংকল্পটি স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। সামাজিক কেন্দ্রই তাকে তার রোহিঙ্গা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একটি কবিতা লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
হৃদয় যেখানে, নিজ আবাসও সেখানে
যতবার সে ভাবে একটি ভালো স্বপ্ন গড়বে
ততবার চোখের সন্মুখে ভেসে ওঠে যন্ত্রনার স্মৃতি।
ভয়াল শব্দে উড়ে আসে চিল,
মরা নদী, দুঃখ ধূসর পলীহীন বালুচর
স্বপ্ন আর দেখা হয় না তখন।
যতবার ভাবে একটি নিঁখাদ কবিতা লিখবে
ততবার রক্ত সৈকতের কথা মনে পড়ে যায়।
অন্ধকার সূর্যের কান্না শুনতে পায়
শুধু এক আকাশ যন্ত্রণা
সমস্ত চেতনায় ভিড় জমায়
তখনি তার দেশের কথা মনে পড়ে যায়।
কবে যে সে দেশে ফিরতে পারবে।
সেই চিন্তায় আর ঘুম হয় না।
বারবার দেশের জন্য কেঁদে উঠে মন
কিন্তু হায় দেশে তো আর যেতে পারবে না
তাই বিষন্ন বদনে বসে থাকে।
বাংলাদেশে এসে যত সুখ পাই না কেন
তবুও দেশের টানে মন কেঁদে উঠে।
সে দেশে তার কত কিছু ছিল
গোয়াল ভরা গরু ছিল
গোলা ভরা ধান ছিল
তবুও যদি বাংলাদেশে প্রাণটা নিয়ে দৌঁড় দিল
মনটা রেখে এলো নিজ দেশে
তাই বলি, “হৃদয় যেখানে নিজ আবাসও সেখানে।”

ঘোষণা: গোপনীয়তা রক্ষায় কিছু ব্যক্তির নাম এবং পরিচয় পরিবর্তন করা হয়েছে।
স্থিতিশীলতা এবং শান্তিতে সহায়তাকারী ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইন্সট্রুমেন্টের (আইসিএসপি) সহযোগিতায় ইউনিসেফের এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাড়ানো, এবং রোহিঙ্গা ও স্বাগতিক বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সংহতি শক্তিশালী করা ও নিজেদের মধ্যে ব্যবধানকে কমিয়ে আনা। প্রকল্পের ডিজিটাল ব্রোশিও’র (digital brochure) এবং পোস্টার (poster) এখানে ডাউনলোড করতে পারেন ।
এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় করা হয়েছিল। এই প্রকাশনাটির বিষয়বস্তুর সম্পূর্ণ দাবীদার ইউনিসেফ এবং এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামত প্রতিফলিত হয় না।