“আমরা জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার চাই। আমরা আমাদের অধিকার চাই!”
জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শিশুদের জলবায়ু ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের দাবিতে বাংলাদেশের শিশু ও তরুণরা সোচ্চার হয়েছে

- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম শহর বরিশাল। তিন শতাধিক শিশু ও তরুণ রাস্তায় নেমে স্লোগান দিতে থাকে:
“আমরা জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার চাই!”; “আমরা আমাদের অধিকার চাই”; “জলবায়ু নিয়ে পদক্ষেপ… এখনই, এখনই!”; “অব্যবস্থা উপড়ে ফেলো!”
বাংলাদেশের প্রতি তিনজন শিশুর একজন -- প্রায় দুই কোটি শিশু -- প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বহন করে চলেছে। দেশজুড়ে জলবায়ু নিয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শিশুদের সোচ্চার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বন্যা, নদী ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারনে বহুমুখী পরিবেশগত সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে শিশুরা। এর ফলে অনেকেরই ঠাঁই হচ্ছে শহরের বস্তিগুলোতে, যেখানে তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ছে। লাখ লাখ শিশু বঞ্চনামূলক শিশু শ্রম, বাল্য বিবাহ ও পাচারের শিকার হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে তাদের নিজেদের জীবন ও সমাজে প্রভাব ফেলছে, কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে, বৈশ্বিক ‘ফ্রাইডেজ ফর দ্য ফিউচার’ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে কেন তারা রাস্তায় নেমেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন পাঁচ তরুণ। কীভাবে তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে আওয়াজ তুলছেন তাও ব্যাখ্যা করেছেন তারা।

রবিউল: আমার ঘর ভেসে গেছে
১২ বছরের রবিউল বলে, “আমি বরিশালের একটি বস্তিতে থাকি। আগে কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী একটি গ্রামে আমাদের পরিবার বাস করতো। নদী ভাঙনে আমাদের ঘরবাড়ি ভেসে যায় এবং আমরা শহরে চলে আসতে বাধ্য হই।”
রবিউল ইসলাম বলে, “বর্ষা মওসুমে জমে থাকা পানিতে আমাদের কাজকর্ম ও চলাচল ব্যাহত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে টিনের চালার ঘরগুলোর ওপর বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ে এবং রাস্তায় বিদ্যুতের তার পড়ে থাকে। এতে ঘরের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও আমাদের প্রাণহানিও হতে পারে। সে কারণে আমাদের অবশ্যই ঘরের ভেতরে থাকতে হয়। আমি স্কুলে যেতে পারি না। আমার বাবা কাজে যেতে পারেন না। মাঝে মাঝে আমাদের কম খেয়ে থাকতে হয়, আবার কখনো কখনো না খেয়েই থাকি।”

মাহজাবিন: তরুণদের কণ্ঠস্বর জোরালো হলে পরিবর্তন আসতে পারে
১৮-বছর বয়সী মাহজাবিন মুমু বলেন, “আমি বিশ্বাস করি এ বিষয়ে আরও সোচ্চার হলে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন হতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা টিকে থাকতে পারি এবং আরও ভালো ভবিষ্যৎ পেতে পারি।”
মাহজাবিন ব্যাখ্যা করে বলেন, লেখাপড়া করাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া ভারী বৃষ্টিতে শহরে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে এবং তাকে ঘরে আটকে থাকতে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মশার বংশবিস্তার বৃদ্ধিসহ নানা অসুখ-বিসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়াটাও তার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিথী: আমরা কীভাবে বাঁচবো?
বাংলাদেশের নদী রক্ষায় সক্রিয় একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট ২০ বছর বয়সী বিথী আখতার বলেন, “আমরা নিজেদের সুখের জন্য পৃথিবীর বয়স কমিয়ে দিচ্ছি। আমরা কীভাবে বাঁচবো? আমরা খাবার পাব কোথায়? পানি কোথা থেকে পাবো? আমরা সাঁতার কাটবো কোথায়?”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে অবগত বিথী আক্তার। তার ভাষ্যমতে, এর ফলে আরও বেশি শিশুর বাল্যবিয়ে হবে, শিশুশ্রমে যেতে বাধ্য হবে, আরও বেশি সংখ্যক শিশু বেড়ে উঠবে বস্তিতে, যারা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার পাবে না।
বিথী আখতার বলেন, “আমার বয়স ২০ বছর। কিন্তু আমার শারীরিক বৃদ্ধি ১০ থেকে ১২ বছরের একটি মেয়ের মতো।”

তায়েবা: নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে
১৬-বছর বয়সী তায়েবা আক্তার বলেন, “আমি শিশুদের ভবিষ্যৎ এবং তারা কীভাবে বেঁচে থাকবে তা নিয়ে চিন্তিত। নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে এবং শিশুদের সুরক্ষা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।”
জলবায়ু পরিবর্তণের কাজে নিয়োজিত সংস্থা ব্রাইটার সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন তায়বো। পাশাপাশি তিনি গার্লস গাইড-এর একজন সদস্যও, যেখানে সে সমবয়সীদের মধ্যে পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেন।

মাহিব: আপনাদের নিষ্ক্রিয়তাই আমাদের ক্ষতি করছে
১৮-বছর বয়সী মাহিব রেজা বেড়ে উঠেছেন উত্তরবঙ্গে যেখানে তীব্র গরম ও পানির ঘাটতি আর বর্ষা মওসুমে বন্যা ও নদী ভাঙন দেখা দেয়।
মাহিব বলেন, “আমাদের প্রজন্মের একসঙ্গে কাজ করা এবং নেতাদের কাছ থেকে আরও পদক্ষেপ দাবি করা উচিত। একজন তরুণ হিসেবে আমাদের নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে সমস্যা আমরা মোকাবেলা করছি তা আমাদের সৃষ্টি নয়। আপনাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই আমাদের ভুগতে হচ্ছে।”
মাহিব ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত প্রজন্ম সংসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শিশুদের জলবায়ু ঘোষণাপত্র প্রণয়নের পেছনে ১০ লাখ শিশু জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে মাহিবও ছিলেন।
২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম শিশু জলবায়ু সম্মেলনে (চিলড্রেন’স ক্লাইমেট সামিট) জলবায়ু ঘোষণাপত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে সেটা জাতীয় সংসদে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আইনপ্রণেতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জলবায়ু ঘোষণাপত্রে শিশুরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করা; দূষণ ও গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা; শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সবুজ (পরিবেশবান্ধব) অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; এবং শিশুদের ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলে এমন নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নের সময় তাদের বক্তব্যের প্রতি কর্ণপাত করা।